বদলে যাচ্ছে ঢাকা, কমবে যানজট
৩০ এপ্রিল ২০২১স্বাধীনতার ৫০ বছরের বিজয় দিবসে মেট্রোরেল চালু হবে উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত৷ এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে চলছে প্রস্তুতি৷ এরই মধ্যে জাপান থেকে কোচ আসা শুরু হয়েছে৷ প্রথম দফায় ৬টি কোচ ইতিমধ্যে ঢাকায় পৌঁছে গেছে৷
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. মো. শামসুল হক বলেছেন, ‘‘এটা অবশ্যই অনেক বড় সুখবর৷ এটা অনেক আগেই হওয়া উচিত৷’’
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, ‘‘ঢাকার যানজট এবং পরিবেশে মেট্রোরেলের অসামান্য প্রভাব পড়বে৷’’
এমনকি পরিকল্পনা অনুসারে ঢাকায় মেট্রোরেলের সবগুলো রুট বাস্তবায়িত হলে তীব্র যানজটের শহর ঢাকার যানজট কমবে এবং এর ফলে দেশের জিডিপি এক শতাংশ বেড়ে যাবে বলেও মনে করেন তিনি৷
ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল
ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলের নাম এমআরটি-৬৷ এটি উত্তরা থেকে শুরু হয়ে মিরপুর, ফার্মগেট, মতিঝিল হয়ে কমলাপুর যাবে৷ উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ২৯ কিলোমিটার অংশ চলতি বছরের ডিসেম্বরে এবং আগারগাঁও থেকে কমলাপুর পর্যন্ত প্রায় ১১ কিলোমিটার ২০২৩ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য ছিল৷ এটি এগিয়ে নিয়ে আসার কাজ চলছে৷
বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, ‘‘প্রতিদিন ভোররাতে ফজরের আজানের সময় মেট্রোরেল চালু হবে৷ চলবে রাত একটা পর্যন্ত৷ ইজতেমা, ক্রিকেট বা ফুটবল খেলার মতো উপলক্ষ্যে এই শিডিউল মানুষের চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করা হবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘মেট্রোরেল চালু হলে দুই জায়গায় প্রভাব পড়বে৷ প্রথমত: সময়৷ উত্তরা থেকে কমলাপুর যেতে এখন ২-৩ ঘণ্টা সময় লাগে৷ মেট্রো হলে সময় লাগবে মাত্র ৩৮মিনিট৷ এই সময়ের মধ্যেই ১৭টি স্টেশনের প্রতিটিতে ৩০-৪৫ সেকেন্ড থামবে৷ এই বেঁচে যাওয়া সময় অন্য ব্যক্তিগত ও সামাজিক কাজে লাগাতে পারবে মানুষ৷ দ্বিতীয়ত: তখন শহরে জ্বালানি পোড়ানো অনেক কমে যাবে৷ এতে ঢাকার পরিবেশের উন্নয়ন হবে৷''
ঢাকার কেবল মেট্রোরেল-৬ প্রতিদিন ৫ লাখ যাত্রী পরিবহন করতে পারবে বলে আশা করছে কর্তৃপক্ষ৷
মেট্রোরেলের যত প্রকল্প
ঢাকার মেট্রোরেলের আরো পাঁচটি প্রকল্প রয়েছে৷ এমআরটি লাইন-১, যার অধীনে আবার দুটো রুট হবে৷ বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর রুটকে বিমানবন্দর রুট বলা হচ্ছে, আর নতুন বাজার থেকে পূর্বাচলকে পূর্বাচল রুট বলা হচ্ছে৷ পরিকল্পনা অনুসারে এটা চালু হবে ২০২৬ সালে৷
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, ‘‘এই রুটের সব প্রাথমিক সার্ভে, বেসিক ডিজাইন করা শেষ৷ ডিটেইল ডিজাইনের কাজও শেষ হওয়ার পথে৷ এখন এটা নির্মাণের জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়ায় আমরা যাচ্ছি৷’’
এমআরটি লাইন ৫ (উত্তর) সাভারের হেমায়েতপুর থেকে গাবতলী-মিরপুর-বনানী-গুলশান-২ হয়ে ভাটারা যাবে৷ এটি চালু হবে ২০২৮ সালে৷ এটার সার্ভে এবং ডিজাইনের কাজ চলছে৷
এমআরটি লাইন-৫ (দক্ষিণ) গাবতলী-কল্যাণপুর-আসাদগেট-পান্থপথ-হাতিরঝিল-আফতাবনগর হয়ে পূর্ব দাশেরকান্দি যাবে৷ এর বেসিক ডিজাইন করতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়েছে৷ এমআরটি লাইন-২ গাবতলী-বসিলা-মোহাম্মদপুর-সাতমসজিদ রোড-ঝিগাতলা-সায়েন্সল্যাব-আজিমপুর-পলাশী-শহীদ মিনার-ঢাকা মেডিকেল-পুলিশ হেডকোয়ার্টার-গোলাপ শাহ মাজার-মতিঝিল-আরামবাগ-মুগদা-মান্ডা হয়ে চিটাগাং রোড যাবে৷ এর প্রাথমিক সমীক্ষা চলছে৷
এমআরটি লাইন-৪ ঢাকার কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ যাবে৷ এটা করা হবে পিপিপি পদ্ধতিতে৷ পিপিপি পদ্ধতিতে করার প্রক্রিয়া চলছে৷ এমআরটি লাইন-৫ (দক্ষিণ), এমআরটি লাইন-২, এমআরটি লাইন-৪ চালু হবে ২০৩০ সালে৷
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, ‘‘প্রথম মেট্রোরেল করার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন এনেছি৷ যেসব লাইন শহরের মধ্য দিয়ে যাবে, সেগুলো মাটির নীচ দিয়ে যাবে৷ যেমন, এমআরটি লাইন-১ এর অধীনে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর রুট মাটির নীচ দিয়ে যাবে৷ আবার নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল রুট হবে এলিভেটেড৷’’
মেট্রোরেলের যে ঘাটতি রয়েই গেছে
অধ্যাপক এম শামসুল হক৷ তিনি দেশের অন্যতম সফল প্রকল্প হাতিরঝিল পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷ দেশের শীর্ষস্থানীয় পরিবহন বিশেষজ্ঞদের অন্যতম তিনি৷ ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থার নবসংযোজন মেট্রোরেলের প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি বলেন, ‘‘এই ঘনবসতির শহরে অনেক আগেই এটা হওয়া উচিত ছিল৷ এতদিন হয়নি, এখন হয়েছে৷ এটা বিশ্বজুড়ে নগরের সর্বাধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা৷’’
মেট্রোরেলকে ঢাকার পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসাবে স্বীকার করলেও তার মতে, এই প্রকল্পের সব সুবিধা নিতে হলে আরো বড় পরিসরে ভাবা দরকার ছিল৷
তিনি বলেন, ‘‘মেট্রো কিন্তু কেবল পরিবহন খাতের উন্নয়ন প্রকল্প না, এটা একটা নগর পরিকল্পনার গাইডলাইন৷’’
শামসুল হক বলেন, ‘‘মানুষের বসবাসের জায়গা কোনটা হবে, পরিবহন ব্যবস্থা সেটা নির্ধারণে সহযোগিতা করে৷ যেমন, ঢাকায় সন্তান যেখানে পড়ে, অভিভাবকরা তার আশেপাশেই থাকেন৷ তার মানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের বাসস্থানকে প্রভাবিত করছে৷ একইভাবে মেট্রো যেহেতু শহরের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও দ্রুতগামী যোগাযোগ ব্যবস্থা, তাই মানুষ এটা বোঝার পর স্টেশনের আশপাশে গিয়ে থাকার চেষ্টা করবে৷''
‘‘এখন সে থাকতে চাইলেই তো হবে না, সেখানে ব্যবস্থা থাকতে হবে’’
তিনি বলেন, ‘‘এখন ঢাকায় একটা জেনারেল রুল দেয়া আছে যে, আবাসিক এলাকায় ছয়তলার বেশি হতে পারবে না৷ তাহলে দেখা যাবে, মানুষ থাকতে চাইলেও থাকতে পারবে না৷ তখন দেখা যাবে, তিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের রিটার্ন আসবে না৷ মেট্রো স্টেশনের পাশে থাকার অর্থ হাঁটার দূরত্বে থাকা৷’’
‘‘(বিদেশে)মেট্রো স্টেশনের পাশে কিন্তু শততলা ভবনও অ্যালাও করে৷ এমনভাবে অ্যালাও করে, একপাশে অফিস-ব্যবসা-বাণিজ্য৷ শেষের পেরিফেরিতে থাকার জায়গা৷ এটা হয়ত তিন-চার স্টেশন দূরেও হতে পারে৷ যেখানে থাকা, সেখানেই চাকরি৷ এটা একটা দর্শন আছে৷ সেই দর্শনটা আমাদের এখানে মিসিং৷’’
শামসুল হক বলেন, ‘‘হংকং, সিঙ্গাপুর, জাপান দেখিয়েছে যে, যেখানে ১০তলা ভবন হয়েছে, সেখানে কীভাবে বড় ভবন হবে৷ এটার জন্য কিন্তু কোনো অধিগ্রহণ দরকার নাই৷ এর জন্য দরকার রিডেভেলপমেন্ট৷ মালিককে যদি বলি, আপনার এখানে এখন ৬তলা ভবন, এখানে অ্যাম্বুলেন্স ঢোকে না, ফায়ার ব্রিগ্রেড ঢোকে না৷ আমার সাথে পার্টনারশিপে আসেন, আমি রিডেভেলপমেন্ট করে দেবো৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘যারা এটা বাস্তবায়ন করছেন, তারা কেবল মেট্রোরেল প্রকল্পের দিকে তাকিয়ে আছেন৷ বাইরে কিন্তু এটাকে সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট হিসাবে নেয়৷ তখন স্টেশনের পাশে লাখ লাখ লোক থাকলেও যানজট হয় না৷ কারণ, মানুষ ছোট গাড়ি ব্যবহার করবে না৷ ট্রান্সপোর্ট এবং ল্যান্ড ইউজকে একত্রিত করে পরিকল্পনা করলে সেই শহর হয়ে যায় স্মার্ট৷ পুরো বিশ্ব শত বছরের অভিজ্ঞতায় ট্রায়াল অ্যান্ড এররের মাধ্যমে মেট্রোকে যে জায়গায় নিয়ে এসেছে, সেই অংশটুকু কিন্তু আমরা নেই নাই৷’’
আরো যত প্রকল্প
ঢাকায় আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্প হলো বাস রুট রেশনালাইজেশন বা বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি প্রকল্প৷ যেটা চলতি বছরের এপ্রিল থেকে পাইলট আকারে চালু হওয়ার কথা ছিল৷ করোনাভাইরাসের কারণে এটা এখন চাপা পড়ে গেছে৷ পাইলট প্রকল্পে ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত লাইন চালু হওয়ার কথা ছিল৷
এই প্রকল্পের আওতায় ঢাকার বাস রুটগুলোকে বিভিন্ন কোম্পানির অধীনে ভাগ করে দেয়া হবে, সব বাসকে এসব কোম্পানির অধীনে চলতে হবে৷ প্রতিটি কোম্পানির গাড়ির রং হবে আলাদা আলাদা৷ যাত্রী উঠানো-নামানোর জন্য থাকবে নির্ধারিত স্থান৷
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সাড়ে ২০ কিলোমিটার পথে নির্মাণ চলছে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প৷ এই পথে বাসের জন্য আলাদা লেন থাকবে, যেখানে ঘণ্টায় ২৫ হাজার যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে৷ এই প্রকল্পটি ২০২২ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল৷ তবে এর অগ্রগতি নিয়ে নানা মহলে অসন্তোষ রয়েছে৷
ঢাকার চারপাশে বৃত্তাকার রেলপথ, সড়কপথ এবং নৌপথ চালুর নানা উদ্যোগও নেয়া হয়েছে৷ এর মধ্যে একসময় বৃত্তাকার নৌপথ চালুর অংশ হিসাবে ওয়াটার বাস চালুও করা হয়েছিল৷ পরে ওয়াটার বাসের সংখ্যা বাড়ানো হয়৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই পরিবহনগুলো বন্ধ হয়ে যায়৷
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক এম শামসুল হক বলেন, ‘‘এরকম নানা প্রকল্পে এসব ব্যর্থতার কারণ হচ্ছে, এখানে যে যার যার মতো কাজ করে৷ কেউ কারো সঙ্গে সমন্বয় করে না৷ নগরের চারপাশে নদীতো দূরে থাক৷ বহু শহরের পাশে একটা নদীও নেই৷ অথচ আমরা আমাদের নদীপথকে কাজে লাগাতে পারছি না৷’’
‘‘বর্ষাকালে ঢাকার চারপাশে নদীতে যাত্রী পরিবহন করতে হলে কিছু ব্রিজ ভাঙতে হবে৷ তার মানে যারা ব্রিজ বানিয়েছে, তারা নদীপথের কথা চিন্তা করে নাই’’
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের মেট্রোরেল হচ্ছে, কিন্তু এই কাজের সাথে রাজউক নাই৷’’
শামসুল হক মনে করেন, ‘‘এমন একটা কর্তৃপক্ষ থাকতে হবে, যে এসবের সঙ্গে নগর পরিকল্পনাকে সনম্বয় করবে৷ কোনো দেশে নগর সরকার এটা করে৷ দিল্লিতে একজন মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন৷ তারা এটা করে৷’’
‘‘সেই সমন্বয় থাকলে যিনি সদরঘাটে নামবেন, তিনি মতিঝিল পর্যন্তও সহজে পৌঁছতে পারবেন, সেই ব্যবস্থা থাকবে৷ বাস পেতে তাকে ভিক্টোরিয়া পার্ক পর্যন্ত আসতে হবে না৷’’