বনের চেরিকুঞ্জে আমন্ত্রণ
১৮ এপ্রিল ২০২২আবহাওয়া ভালো থাকলে মার্চ মাসের শেষেই বন শহরের আল্ট স্টাড বা ওল্ড টাউনে দু'টি রাস্তায় চেরি গাছগুলোতে গোলাপি আভার দেখা পাওয়া যায়৷ রোদের দিন থাকলে ফুল তাড়াতাড়ি ফুটতে থাকে৷ এবার এপ্রিলের শুরুতে বন শহরে বৃষ্টি আর ঠান্ডার কারণে ফুল ভালোভাবে ফুটতে সময় নিচ্ছিল৷ কিন্তু ইস্টারের ছুটির আগে অর্থাৎ এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে ব্রাইটে স্ট্রাসে আর হেয়ার স্ট্রাসের গাছগুলো ফুলের ভারে নুয়ে পড়লো৷
ব্রাইটে স্ট্রাসের একটি শতবর্ষ পুরোনো বাড়িতেই আপাতত আমার বাস৷ ২০১৮ সাল থেকে এখানে আছি৷ ২০১৯ সালে প্রথম বাড়িতে বসে এখানকার চেরিফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ হয়৷ শীতে ঝরে পড়া পাতায় নতুন কুড়ি থেকে একটু একটু করে ফুল ফোটা, তারপর ঝরে পড়া পুরোটাই দেখতে ভীষণ ভালো লাগে৷ সব ফুল ফুটে যাওয়ার পর কেবল ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই ফুল দেখতে ছুটে আসেন পর্যটকেরা৷ দুই থেকে তিন সপ্তাহ থেকে ধীরে ধীরে ঝরতে থাকে ফুল৷ সেটাও অসাধারণ দৃশ্য৷
তবে শত শত মানুষের কারণে স্থানীয়রা অনেক সময় বিরক্ত হয়ে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড টাঙিয়ে রাখেন জানালায়৷ যেখানে লেখা থাকে, ‘দয়া করে চিৎকার করবেন না৷ আমাদের অসুবিধা হচ্ছে৷' আবার অনেক সময় দেখেছি উল্টোদিকের বাড়ি থেকে এক বৃদ্ধা চিৎকার করে বলছেন, ‘সব পাগল এখানে এসে জুটেছে৷ আমাদের শান্তিতে থাকতে দাও৷'
আল্ট স্টাডের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এখানকার অনেক পুরোনো ক্যাফে ও বার৷ আর আছে কিছু রোমান ধ্বংসাবশেষ৷ যেগুলো এখানকার রাস্তাগুলোর সৌন্দর্যে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে৷ চেরিব্লসমের সময় ক্যাফে ও বারগুলোতে তিল রাখার জায়গা থাকে না৷ রাস্তায়ও হাতে কফি বা বিয়ারের গ্লাস হাতে মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়৷ মধ্যরাত পর্যন্ত বারগুলোতে মানুষের আনা-গোনা আর হৈ-হুল্লোড় চলতে থাকে৷
এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহের এক শনিবারে এখানে প্রতিটা বাড়ির সামনে ছোট শিশুরা তাদের পুরানো বই আর খেলনা নিয়ে দোকান সাজিয়ে বসে৷ ৫০ সেন্ট থেকে ৫ ইউরো দিয়ে আপনি পুরানো-নতুন বই থেকে শুরু করে খেলনা, ছোট-বড়দের কাপড়, সাইকেল পর্যন্ত কিনতে পারেন৷
গত ১০ বছরে এই চেরিফুল বনেরল্যান্ডমার্ক হয়ে উঠেছে এবং আজ বন ‘চেরি ব্লসম ডিসট্রিক্ট' নামে পরিচিত৷ ৮০'র দশকে বনের ওল্ড টাউনের পুরোনো ধূসর রঙের বাড়ি এবং ভয়াবহ যানজট থেকে মুক্ত হতে শহর কর্তৃপক্ষ এখানকার মানুষের জীবন মানের উন্নয়নের জন্য এলাকায় সবুজের সমারোহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেন৷
ঐতিহাসিক শতবর্ষ পুরোনো ভবনগুলো সংস্কার করা হয়৷ সড়কে যান চলাচল একমুখী করা হয়৷ প্রতিটা ভবনের সামনে ছোট ছোট বাগান করা হয়৷ ঠিক এই সময় লাগানো হয় এই চেরি গাছগুলো৷
গত ১০ বছরে বন শহরের মূল আকর্ষণে পরিণত হয়েছে এই চেরি গাছগুলো৷ কেবল ফুল ফোটার সময়ই নয়, যখন সবুজ, অথবা হলুদ পাতায় ভরে থাকে গাছগুলো, তখনও অনেকেই বিয়ে বা জন্মদিনের ছবি তোলার জন্য জায়গাটিকে বেছে নেন৷
২০২০ সালে করোনা হানা দেয়ার কারণে চেরি ব্লসমের সময় এই দুটো সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে পর্যটকদের প্রবেশ নিষেধ করা হয়েছিল৷ স্থানীয়দের মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক ছিলো, রেসিডেন্স কার্ড দেখিয়ে রাস্তায় ঢোকার অনুমতি দেয়া হয়েছিল৷ তবে সেবার প্রকৃতিও ভিন্ন রূপে প্রকাশিত হয়েছিল৷ যেদিন থেকে চেরিফুল ঝরা শুরু হল, একদিন তুষারপাতও শুরু হল৷ হালকা তুষার আর চেরির পাতা একসাথে ঝরছে, কি যে অপূর্ব দৃশ্য!
এবার করোনার প্রকোপ কম৷ বন শহরে করোনার বিধি নিষেধ শিথিল করা হয়েছে৷ তাই এবারও চেরি ব্লসমে ছিল উপচে পড়া ভিড়৷ যেদিন থেকে আবহাওয়া ভালো হতে লাগলো মানুষও বাড়তে লাগলো৷ গত দু বছরে করোনার কারণে মানুষের মানসিক পরিস্থিতিতেও বদল ঘটেছে৷ তাই এবার এত মানুষ এলেও অভিযোগ জানিয়ে কেউ কোন কথা বলছে না৷ জানলা খুলে সেই বৃদ্ধাও মানুষকে হাসিমুখে অভিবাদন জানাচ্ছেন৷
আমাদের বাড়িওয়ালা এই বাসায় থাকেন না৷ তবে এখানে তার অফিস৷ করোনাকালে তিনি স্যাক্সোফোন শিখেছেন, তার স্ত্রী বাঁশি শিখেছেন, আর বন্ধু-বান্ধবরা মিলে তৈরি করেছেন একটা ব্যান্ড৷ গত সপ্তাহে সেই ব্যান্ড এই বাড়িতেই পারফর্ম করলো৷ বাসার সামনে শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে সেই কনসার্ট শুনলেন৷ করতালিতে অভিবাদন জানালেন তাদের৷ মনে হল আবারও ফিরে এসেছে স্বাভাবিক সময়৷
ব্রাইটে স্ট্রাসেতে এখন অন্যতম বিখ্যাত রেস্তোরাঁ ক্যাফে কামু৷ সেই ক্যাফের মালিক ক্যাথেরিনার সাথে গতকাল বিকেলে যখন কথা হল তখন তার মুখে তৃপ্তির আভাস৷ অনেক অতিথি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, কিন্তু করোনা পেড়িয়ে তার ব্যবসা যে স্বাভাবিক গতি পেয়েছে সেই তৃপ্তি তার চোখে মুখে৷
গত দুই বছরও আমিও কাউকে আমন্ত্রণ জানাইনি বাড়িতে৷ কিন্তু এই অপূর্ব দৃশ্য দেখার সুযোগ যাদের আছে, তাদের আমন্ত্রণ জানাই৷ বলি, ‘আমাদের চেরিকুঞ্জে আপনাদের আমন্ত্রণ'৷