‘বন্দুকযুদ্ধে' গাজীপুরেও কি নিরপরাধ ব্যক্তি নিহত?
১৪ জুন ২০১৮গাজীপুরে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ গত ১ জুন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ‘বন্দুকযুদ্ধে' মাদক ব্যবসায়ী কামাল খান ওরফে কামরুল ইসলাম ওরফে কামু (৪০) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছে বলে জানায়৷ এর আগের দিন, অর্থাৎ বৃহস্পতিবার (৩১ মে) দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে গাজীপুরের ভাদুন এলাকায় ওই ‘বন্দুকযুদ্ধের' ঘটনা ঘটে বলে জানানো হয়৷ ডিবি জানায়, নিহত কামু টঙ্গির এরশাদ নগর এলাকার মৃত সিরাজ উদ্দিন খান ওরফে তমিজ উদ্দিন খানের ছেলে৷
ডিবি'র ভাষ্য অনুযায়ী, গাজীপুরের কালীগঞ্জের উলুখোলা এলাকায় মাদক বেচাকেনার খবর পেয়ে ৩১ মে রাত ১০টায় সেখানে অভিযান চালানো হয়৷ তখন উলুখোলা মসজিদের পাশের রাস্তা থেকে মাদক বিক্রির সময় কামাল খান ওরফে কামরুল ইসলাম ওরফে কামুকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এ সময় তার কাছ থেকে চার হাজার পিস ইয়াবা ও একটি এলিয়ন প্রাইভেটকার জব্দ করা হয়৷ কালীগঞ্জ থানায় মামলা দিয়ে আসার পথে ভাদুন এলাকায় পৌঁছালে তার সহযোগীরা পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে৷ এ সময় সে গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে৷ পুলিশ আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছুড়লে কামু গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায়৷
ডিবি আরো দাবি করে, কামরুল ইসলাম কামুর বিরুদ্ধে গাজীপুর, কালীগঞ্জ, ঢাকার শেরেবাংলা নগর ও নারায়ণগঞ্জ থানায় হত্যা, ডাকাতির চেষ্টা, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসাসহ ১৪টি মামলা রয়েছে৷
কিন্তু দু-একদিনের মধ্যেই বেরিয়ে আসে অন্যরকম তথ্য৷ জানা যায়, ‘মাদক ব্যবসায়ী' কামু বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছে বলে পুলিশ দাবি করলেও তিনি আসলে কাশিমপুর কারাগারে আটক আছেন৷ কারা কর্তৃপক্ষও তা নিশ্চিত করে৷ তাই প্রশ্ন ওঠে, ‘বন্দুকযুদ্ধে' কে নিহত হলেন?
অবশেষে ওই নিহত ব্যক্তিরও পরিচয় মেলে৷ তাঁর নাম কামাল খান ওরফে কামু৷ গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার উলুখোলা-রায়েরদিয়া (গাইনীপাড়া) গ্রামের মৃত সিরাজ খানের ছেলে তিনি৷ একই এলাকার ইটালি প্রবাসী রুবেলের বাড়িতে তিনি ভাড়া থাকতেন৷
তাঁর স্ত্রী আছমা বেগম সংবাদ মাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেন, ‘‘কোনো বন্দুকযুদ্ধ নয়, ৩১ মে ভোর পাঁচটার দিকে কামালকে বাড়ি থেকে ডিবি পুলিশ ধরে নিয়ে যায়৷ পরে তাঁকে হত্যা করা হয়৷ ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় বাসার স্বর্নালংকারসহ মূল্যবান সামগ্রী লুটও করা হয়৷''
আছমা বেগম আরো বলেন, ‘‘আমার স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো অস্ত্র ও মাদকের মামলার কথা কখনো শুনিনি৷ আর কখনো আমরা টঙ্গির এরশাদনগরে থাকিনি৷ টঙ্গির পূর্ব আরিচপুরের বৌ-বাজারে এক সময় থাকতাম৷ আমার স্বামী সেখানকার একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন৷ উলুখোলা-রায়েরদিয়া গাইনীপাড়ায় সামান্য জমি কেনা ছিল আগেই৷ ছয় মাস আগে আমরা গাইনীপাড়ায় ভাড়া বাড়িতে উঠি৷''
আছমা বেগমের দাবি, ‘‘বন্দুক যুদ্ধ থেকে রেহাই দিতে ডিবি মোটা টাকা চাঁদাও দাবি করেছিল৷''
নিহত কামালের স্ত্রী-র সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছিল৷ কিন্তু তাঁকে ফোনে পাওয়া যায়নি৷ তবে তাঁদের প্রতিবেশী সারোয়ার হোসেনের সঙ্গে কথা হয়েছে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ‘‘নিহত কামালকে আমরা খুব ভালো মানুষ বলেই জানতাম৷ তার কোনো খারাপ কিছু আমাদের চোখে পড়েনি৷ সে গার্মেন্টসের ব্যবসা করতো৷ তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় দেখেছি৷ পরে টেলিভিশনে খবর দেখে জানতে পারি, ‘গাজীপুরে মাদক ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম কামু' বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছেন'৷''
সারোয়ার হোসেন জানান, ‘‘তাকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় আমাদের কালিগঞ্জ উলুখোলা এলাকার বাসা থেকে৷ কাউকেই কথা বলতে দেয়নি তারা৷ আমরা নিহত হওয়ার খবর পাওয়ার আগে ডিবি'র সঙ্গে বার বার যোগাযোগ করেও কোনো তথ্য পাইনি৷ তার একটি ছেলে আছে৷''
কামাল মানুষ হিসেবে কেমন– জানতে চাইলে সারোয়ার বলেন, ‘‘আমরা সবাই জানি, কামাল নির্দোষ৷ সে কোনো অপরাধ করেনি৷ কিন্তু আমরা কি প্রমাণ করতে পারবো? আমাদের কথা কি কেউ শুনবে?''
অন্যদিকে পুলিশ যার মৃত্যুর খবর জানিয়েছিল, সেই কামরুল ইসলাম কামু এখনো কারাগারে আছেন বলে ডয়চে ভেলেকে নিশ্চিত করেছেন তার স্ত্রী জ্যোৎস্না বেগম৷ তিনি জানান, ‘‘গত দুই বছর ধরে আমার স্বামী কারাগারে আটক আছেন৷ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে আমি প্রথমে কান্নাকাটি করি৷ পরে সংশয়মুক্ত হতে কাশিমপুর কারাগরে গিয়ে আমার স্বামীর সঙ্গে দেখা করি৷ তিনি ভালো আছেন এবং সুস্থ আছেন৷''
কামুর স্ত্রী জানান, ‘‘২০১৬ সালে টঙ্গির এরশাদ নগরে একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে আমার স্বামী কারাগারে যান৷ তার বিরুদ্ধে মাদক বা অন্য কোনো অপরাধে মামলা আছে কিনা তা আমার জানা নেই৷ তিনি গার্মেন্টস-এর ঝুট ব্যবসা করতেন৷ আমাদের দোকানও আছে৷''
পুলিশের সংবাদ বিজ্ঞপ্তির সঙ্গে কামুর স্ত্রী-র বক্তব্য অবশ্য মিলছে না৷ পুলিশের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়, কামরুল ইসলাম কামু'র বিরুদ্ধে হত্যা, মাদক ও চাঁদাবাজীসহ ১৪টি মামলা আছে৷
তবে ডয়চে ভেলের কাছে জ্যোৎস্না বেগম দাবি করেছেন, ‘‘আমার স্বামীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কারণে এসব মামলা হয়েছে৷ সে রাজনীতি করতো৷''
কারাগারে আটক এই কামুর বাড়ি টঙ্গির আরিচপুরের এরশাদ নগরে৷ তার স্ত্রী জ্যোৎস্না বেগম দুই সন্তান নিয়ে সেখানেই বসবাস করেন৷
পুরো ঘটনা নিয়ে একজন ম্যাজিষ্ট্রেটের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে৷ তবে গাজীপুর জেলা ডিবি পুলিশ স্বীকার করতে নারাজ যে, ‘বন্দুকযুদ্ধে' ভুল বা নিরীহ লোক নিহত হয়েছে৷ গাজীপুর জেলা ডিবি'র ইন্সপেক্টর ডেরিক স্টিফেন কুইয়া ডয়চে ভেলে'র কাছে দাবি করেন, ‘‘প্রেস রিলিজে ভুল হওয়ার কারণে আসলে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে৷ তার নাম আসলে কামাল খান কামু৷ কিন্তু প্রেস রিলিজে কামাল খান ওরফে কামরুল ইসলাম ওরফে কামু লেখায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে৷ এই ভুলটা কম্পিউটার অপারেটর করেছে৷ নিহতের পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র আমাদের কাছে আছে৷ তাতে তার নাম কামাল খান কামু৷ আর কারাগারে আটক যে কামরুল ইসলাম কামুর কথা বলা হচ্ছে, সে যে কারাগারে আটক তা আমরা আগে থেকেই জানতাম৷''
ডেরিক স্টিফেন কুইয়া আরো দাবি করেন, ‘‘যে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছে, তাকেই আমরা খুঁজছিলাম৷ তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাদকসহ ১১টি মামলা আছে৷ সে এক এলাকায় বেশিদিন থাকে না৷ আগে উত্তরায়ও থাকতো৷''
আটকের সময় ঘরের স্বর্ণালংকার লুটপাট এবং মোটা অংকের টাকা দাবির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আমরা তাকে গ্রেপ্তার করেছি রাস্তা থেকে, বাসা থেকে নয়৷ তাই ঘরে লুটপাটের প্রশ্ন অবাস্তব৷ আর আমি যদি এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে থাকি, টেলিফোনে তার নিশ্চয়ই রেকর্ড বা প্রমাণ আছে৷ নিহতের স্ত্রী সেই প্রমান হাজির করুক৷ আমার কথা হলো, যে অভিযোগ করা হচ্ছে তা একশ'তে একশ' মিথ্যা৷''