1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে একরামকে'

সমীর কুমার দে ঢাকা
২ জুন ২০১৮

টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হকের সঙ্গে টেলিফোনে ‘শেষ কথোপকথনের' যে অডিও রেকর্ড তার পরিবার প্রকাশ করেছে, তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করে মানবাধিকার কর্মীরা মাদকবিরোধী অভিযান বন্ধের দাবি জানিয়েছেন৷

https://p.dw.com/p/2ypgg
সংবাদ সম্মেলন
ছবি: DW/S. Kumar Dey

বাংলাদেশে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকে মানবাধিকার কর্মীরা শুরু থেকে সংশয় প্রকাশ করে আসছিলেন, তারা অপরাধীদের গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করার কথাই বলছিলেন৷ বৃহস্পতিবার একরামুল হকের স্ত্রী আয়েশা বেগম কক্সবাজারে সাংবাদিক সম্মেলন করে অডিও প্রকাশ করেন৷ চার ভাগে সেই অডিওতে একরামের সঙ্গে পরিবারের কথোপকথোনের বিষয়টি রয়েছে৷ একরামের ফোন খোলা ছিল বলে এ প্রান্তে পুরো ঘটনাপ্রবাহ রেকর্ড হয়েছে ফোনের অটোরেকর্ডারে৷ সেটাই তিনি মিডিয়ার হাতে তুলে দেন৷

প্রায় সাড়ে ১৪ মিনিটের সেই অডিওতে অনেক কিছুই উঠে এসেছে৷ চারটি ক্লিপ মিলিয়ে ১৪ মিনিট ২২ সেকেন্ডের ওই অডিও রেকর্ডে কয়েকজনের কণ্ঠ, গুলির শব্দ আর চিৎকার সাংবাদিকদের শুনিয়ে একরামের স্ত্রী আয়েশা বেগম অভিযোগ করেছেন, তার স্বামীকে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে৷

আয়েশার বিবরণ অনুযায়ী, একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তার ক্রমাগত ফোন পেয়ে ২৬ মে রাত ৯টার দিকে একরাম বাড়ি থেকে বের হন৷ সর্বশেষ রাত ১১টা ৫৪ মিনিটে ফোন করেন একরামের স্ত্রী৷ ফোন রিসিভ হলে আয়েশা বলেন, ‘‘হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো কে? হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো আমি কমিশনারের সাথে কথা বলতে চাচ্ছি৷ হ্যালো কে ওইটা, ফোন রিসিভ করছে ওইটা কে? আমি উনার মিসেস বলতেছি, হ্যালো, হ্যালো৷'' এমন সময় ফোনের অপর পাশে কাউকে বলতে শোনা যায়- ‘তুমি যেটা বলছ, জড়িত না? কেউ একজন বলেন, নাহ৷ এরপর দু'টি গুলির শব্দ শোনা যায়৷ সেই সঙ্গে মরণাপন্ন কারও গোঙানি৷ ওই আওয়াজে চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন একরামের স্ত্রী ও মেয়েরা৷ পরে আরও তিনটি গুলির শব্দ শোনা যায়, সঙ্গে অকথ্য গালি৷ ফোনের এ প্রান্ত থেকে আয়েশা বলতে থাকেন, তার স্বামী কিছু করেনি, কেন তাকে মারা হচ্ছে৷ এক পর্যায়ে ‘খোসাগুলো' খোঁজার কথা বলা হয় ফোনের অন্য প্রান্তে৷ পরে থেমে থেমে বেশ কয়েকটি গুলির শব্দ শোনা যায়৷ একজন বলেন, ‘আর লাগবে না, খোসাগুলো দেখ৷' ১০ রাউন্ড গুলির কথা বলেন একজন৷ আটটি খোসা খুঁজে পাওয়ার কথা জানান একজন৷ সাইরেন বাজতে থাকে৷ আরও গুলির খোসা খুঁজে পাওয়ার কথা জানানো হয়৷

‘‘প্রায়ই র‌্যাবের সদস্যরা আমার স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন’’

ডয়চে ভেলের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় একরামের স্ত্রী জানান, প্রায়ই র‌্যাবের সদস্যরা তাঁর স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন৷ সে ব্যাপারে তিনি স্বামীকে জিজ্ঞেস করলে একরাম বলতেন, তিনি পৌর কাউন্সিলর, যে কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারে৷ আশেয়া আরও জানান তাঁর পরিবারের আর্থিক দৈন্যদশার কথা৷ জানিয়েছেন, একটি টাকাও রেখে যাননি একরাম৷ এই পরিস্থিতিতে দুই মেয়েকে কীভাবে স্কুলে পাঠাবেন? কীভাবে চলবে তার সংসার? সেই প্রশ্ন তুলেছেন তিনি৷ ইয়াবা ব্যবসায়ী হলে তার তো অনেক টাকা থাকতো? কোথায় সেই টাকা? যারা তাকে ইয়াবা ব্যবসায়ী, অনেক টাকার মালিক বলছেন তাদের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন আয়েশা৷ বলেছেন ‘‘তারা এখন সেই টাকা বের করে দিক, আমি কোন অভিযোগ করব না৷ একটা নিরীহ মানুষকে ডেকে নিয়ে হত্যা করল, তারপর তার বিরুদ্ধে মিথ্যা ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগ দিল? এই বিচার আমি কার কাছে চাইব?''

তিনি আরও জানান, তাদের এক রুমের ঘরে নামাজ পড়ার মতো জায়গা নেই৷ একজন একজন করে পর্যায়ক্রমে নামাজ পড়তে হয়৷ সেদিন রাতেও ঘরে থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় একরামের কাছে কোন টাকা ছিল না? গাড়ির তেল কেনার পয়সা ছিল না৷ মেয়েদের টিফিনের টাকা আয়েশার কাছ থেকে ধার হিসেবে নিয়ে বের হয়৷ তিনি দাবি করেন, ‘‘একরাম ইয়াবার কারবারে জড়িত ছিলেন না৷ তার ব্যাংক ব্যালেন্স বা সম্পদেও অস্বাভাবিক কিছু নেই৷''

‘আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য এটাকে তাদের বাণিজ্যের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে’

একরাম মারা যাওয়ার পর থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা প্রতিবাদ করে আসছিলেন৷ তাদের দাবি, একরাম ইয়াবা ব্যবসায়ী নন৷ হয় ভুল করে নতুবা অন্য কোন কারণে তাকে ‘বন্দুকযুদ্ধের' নামে হত্যা করা হয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ নিয়ে খোলা চিঠিও দিয়েছেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান চৌধুরী মাবু৷

শুক্রবার সন্ধ্যায় এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘আমরা বিষয়টি তদন্ত করব৷ একজন ম্যাজিস্ট্রেট বিষয়টি তদন্ত করবেন৷ তিনি যদি মনে করেন ওই বন্দুকযুদ্ধে বেআইনি কিছু হয়েছে, তবে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো৷''

আর র‌্যাবের পক্ষ থেকে মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘যে অডিও রেকর্ডের কথা বলা হচ্ছে আমরা তা আমলে নিয়ে খতিয়ে দেখছি৷''

সারা দেশে চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে ১৩ দিনে শুক্রবার পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ১২৬ জন৷ এদের একজন রেজাউল ইসলাম রনি৷ গত ২০ মে রাতে গাজীপুরের টঙ্গীর নিমতলী এলাকায় পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে' তার মৃত্যু হয়৷ রনির মৃত্যুর পর পুলিশ জানিয়েছে, তার বিরুদ্ধে এক ডজনেরও বেশি মামলা আছে৷ সে একজন ইয়াবা ব্যবসায়ী৷ 

‘দুই জন পুলিশ কর্মকর্তাকে নগদ ২ লাখ টাকা দিয়েছি’

রনির বাবা হাফিজুল ইসলাম জানান, ‘‘ছেলে ইয়াবা ব্যবসায়ী হলে পুলিশ তাকে ধরে মামলা দিক, জেলে পাঠাক৷ তাই বলে মেরে ফেলবে? ওরা আমার ছেলেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর দুই দিনে দুই জন সাব ইন্সপেক্টরকে নগদ ২ লাখ টাকা এবং বিকাশের মাধ্যমে আরো ৫০ হাজার টাকা দিয়েছি৷ তারা কথা দিয়েছিল ছেলেকে ছেড়ে দেবে৷ কিন্তু একদিন সকালে আমার মেয়ে হাসপাতালে গিয়ে দেখে ভাইয়ের লাশ৷''

দরিদ্র হাফিজুল জানান, ‘‘একটা বাড়ি সেটাই বন্ধক রেখে টাকাটা দিয়েছিলাম ছেলেকে মুক্ত করার জন্য৷ এখন ছেলেও হারালাম বাড়িটাও যাবে৷ কার কাছে বিচার দেব?''

রনির নিহত হওয়ার ঘটনায় পুলিশ সদর দফতর থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে৷ ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (অ্যাডমিন অ্যান্ড ফিন্যান্স) আনোয়ার হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের এই তদন্ত কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন- ঢাকা রেঞ্জের (অপরাধ) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আক্তার হোসেন ও গাজীপুর জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ৷ তাদের ৭ কর্মদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দেয়ার কথা৷

‘মাদকবিরোধী অভিযানের বৈধতা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে’

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান এই অভিযান বন্ধের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন৷ তিনি বলেছেন, ‘‘এই অভিযান এখনই বন্ধ করা উচিত৷ কেননা এটি যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে তেমনি আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য এটাকে তাদের বাণিজ্যের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে৷ বিচারহীনতার সংস্কৃতি বাড়ছে এবং মানুষের স্বাধীনতাভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে৷ কেউ অপরাধ করলে তাকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে৷''

একরামের পরিবারের দেওয়া ওই অডিও ক্লিপের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা সমগ্র অভিযানটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে৷ এর বৈধতা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে৷'' তিনি বলেন, ‘‘আমরা যারা মানবাধিকারের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত বা সাধারণ মানুষ যারা প্রথমদিকে এ অভিযানকে খুবই সমর্থন জানিয়েছিল, তারা তো বুঝতে পারছেন এভাবে আইনকে পাশ কাটিয়ে কোনো কাজ করতে গেলে যে কোনো সময় যে কারো বিপদ হতে পারে৷ এটা বোধ হয় এ ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে গেছে৷'' এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে তিনি বলেন, ‘‘সত্য উদঘাটন করতে হবে৷''

এ বিষয়ে আপনার কোনো মতামত থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷