‘বাংলাদেশের ভিক্ষুকের জীবনও অনেক ভালো’
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২বসনিয়া অ্যান্ড হ্যার্ৎসেগোভিনার ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চল উনা-সানা ক্যান্টনে নবনির্মিত ক্যাম্পে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের একজন মোহাম্মদ মাইনুদ্দীন৷
চার বছর আগে ২০১৮ সালে দেশ ছাড়েন মাইনুদ্দীন৷ দালালদের হাত ধরে ইউরোপে পৌঁছার উদ্দেশে বছরের পর বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ঘুরে বসনিয়া পৌঁছান তিনি৷
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমার কাছে থেকে যদি ম্যাসেজ নিতে চান, আমি মনে করি বাংলাদেশের ভিক্ষুকের জীবনও অনেক ভালো যারা বাই পথে আসে তাদের চেয়ে৷ আসলে বাস্তবতা অনেক কঠিন৷ আপনি পাহাড়ে চড়লেন৷ পুলিশের চেক আছে৷ পানি নেই৷ পাহাড়ে উঠতে অনেক কষ্ট হয়৷ খাবার থাকলেও পানির জন্য খাবার খেতে পারবেন না৷ তখন, কেমন লাগে? আসলে যারা বাস্তবতার সম্মুখীন হয় তারাই বলতে পারবে কষ্টটা কেমন৷’’
শুধু মাইনুদ্দীনই নন, গত কয়েক বছর ধরে হাজার হাজার বাংলাদেশি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে পৌঁছার চেষ্টা করছেন৷
অভিবাসন বিষয়ে ইউরোপের সংবাদমাধ্যম ইনফোমাইগ্রেন্টস-এর তথ্যমতে, গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে অবৈধপথে ইউরোপে পাড়ি জমানো অভিবাসীদের শীর্ষে রয়েছেন বাংলাদেশিরা৷
পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অস্থায়ী ক্যাম্পে আটকে আছেন এমন অনেক বাংলাদেশি৷ সেখানকার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে বসনিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্প পরিদর্শন করছেন ডয়চে ভেলে বাংলার সাংবাদিক অনুপম দেব কানুনজ্ঞ ও আরাফাতুল ইসলাম৷
জানা গেছে, বসনিয়ার লিপা ক্যাম্পে পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় তিনশ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী রয়েছেন৷
মাইনুদ্দীন জানান, লিপায় অবস্থিত এ ক্যাম্পটিতে বর্তমানে দশজন বাংলাদেশি আছেন৷ তাদের অনেকেই বসনিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশ ক্রোয়েশিয়া পাড়ি দিয়ে ইটালি পৌঁছার চেষ্টা করছেন৷
যেভাবে বসনিয়ায় পৌঁছালেন তারা
বাংলাদেশ থেকে কীভাবে বসনিয়া পৌঁছালেন এমন প্রশ্নের জবাবে লিপা ক্যাম্পে থাকা আরেক বাংলাদেশি মোহাম্মদ সালাউদ্দীন বলেন, ইটালি যাওয়ার ইচ্ছা তার৷ সে ইচ্ছা থেকেই তিনি বাংলাদেশ থেকে দুবাই তারপর ইরান হয়ে তুরস্কে আসেন৷ তুরস্ক থেকে গ্রিস হয়ে সার্বিয়া এবং সার্বিয়া থেকে বসনিয়া পৌঁছান তিনি৷
এভাবে আসতে অনেক কষ্ট হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘প্রায় আট-নয় মাস ধরে বসনিয়া আছি এবং ক্রোয়েশিয়া হয়ে ইটালি যাওয়ার চেষ্টা করে বার বার ব্যর্থ হচ্ছি৷’’
আর মাইনুদ্দীন জানান, দালালদের হাত ধরে তার ভাষায় ‘জিয়ারত ভিসায়’ প্রথম ইরাকে আসেন৷ তিনি বলেন, ‘‘ইরাকে পরিস্থিতি খারাপ দেখে আমি ইরান হয়ে তুরস্ক যাই৷ কিন্তু তুরস্কে আয়-রোজগারের পথ খুব একটা ভাল নয়৷ তাই সেখান থেকে গ্রিস, আলবেনিয়া হয়ে বসনিয়া এসে পৌঁছাই৷''
মাইনুদ্দীন এবং সালাউদ্দীন জানান, পশ্চিম ইউরোপের দেশ ইটালিতে পৌঁছার লক্ষ্য তাদের৷
কষ্টের জীবন
বসনিয়া পর্যন্ত পৌঁছাতে নানা ধরনের কষ্টের মুখে পড়েছেন বলে জানান এ দুই বাংলাদেশি৷ তারা বলেন, রাতের পর রাত জঙ্গল পাড়ি দিয়ে পানি ও খাবারের অভাবে কষ্ট করে তারা এখানে এসে পৌঁছাতে পেরেছেন৷
বসনিয়া পর্যন্ত আসতে মোট চার বছর লেগেছে মাইনুদ্দিনের৷ তিনি বলেন, ইউরোপ অনেক সহজ মনে হয়েছিল৷ পাহাড়ে চড়তে হয়, সেই সাথে থাকে পুলিশের পাহারা৷ মাসের পর মাস এভাবে চলতে অনেক কষ্ট হয়৷
আর ক্যাম্পেও তাদের খাবারের কষ্টসহ নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে৷ তিনি বলেন, ‘‘ভাত নিয়মিত খেতে পাওয়া যায় না৷ রুটি খেয়ে থাকতে হয়৷’’
অর্থনৈতিক বিষয়ে মাইনুদ্দীন জানান, দালালদের হাত ধরে টাকা আনাতে হয়৷ দালালদের হাত ধরে বাংলাদেশ থেকে টাকা আনাতে হলে অনেক টাকা দালালদের দিতে হয়৷
‘‘দালালদের মাধ্যমে যদি আপনি দশ হাজার টাকা আনাতে চান তাহলে আপনার খরচ পড়বে ১৪ হাজার টাকা৷ অর্থাৎ চার হাজার টাকা দালালদের দিতে হয়৷’’
আর কষ্টের বর্ণনা দিতে গিয়ে সালাউদ্দীন জানান, এখানে আসার পর যে কষ্ট হয় তা আগে জানলে তিনি এভাবে আসার চেষ্টা করতেন না৷
‘গেম মারতে গিয়ে পুলিশের নির্যাতন’
গত আট নয় মাস বসনিয়ায় আছেন সালাউদ্দীন৷ এসময়ে বেশ কযেকবার তিনি ক্রোয়েশিয়া পাড়ি দিয়ে ইটালি যাওয়ার চেষ্টা করেছেন কিন্তু ক্রোয়েশিয়া সীমান্তে পুলিশের নজর এড়াতে পারেননি৷
‘‘প্রায় ৮-১০ বার গেম মারছি, কিন্তু ক্রোয়েশিয়া পুলিশের, মানে ধরা খেয়ে যাই পথে৷ এইখান থেকে যাইতে পারতেছি না, ইটালির দিকে৷’’
তাদের অভিযোগ, ক্রোয়েশিয়া পুলিশের হাতে ধরা পড়লে ভয়ানক নির্যাতন সইতে হয়৷
মাইনুদ্দীন জানান, প্রায় মাস খানেক আগে তিনি সর্বশেষ ‘গেম মারার’ চেষ্টা করেছেন৷ গেম মারার বিষয়ে দালালরা সহযোগিতা করে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ক্রোয়েশিয়ার পুলিশ তো অনেক মারধর করে৷ মারধর মানে তারা এমন মার দেয় যে ফিল্মের মারকে হার মানাবে৷’’