1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বসন্ত বাতাসে বিশ্ব জয়ের সুবাস

উৎপল শুভ্র
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০

এই বসন্তটা অন্যরকম৷ বাংলাদেশের বসন্ত বাতাসে এবার বিশ্ব জয়ের সুবাস৷ ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে কোন সুদূরের পচেস্ট্রুম থেকে ভেসে এসেছিল যে আনন্দ-বার্তা, সেটি এখনো অনুরণন তুলে যাচ্ছে আকাশে-বাতাসে৷

https://p.dw.com/p/3XlNc
Südafrika Potchefstroom  Cricket-Endspiel U19-Weltmeisterschaft Bangladesch vs Indien
ছবি: AFP/M. Spatari

সেই বিমূর্ত আনন্দ অবয়ব পেয়েছে তিন দিন পর বিশ্বকাপজয়ী বীরেরা দেশে ফেরার পর৷ বিমানবন্দরে মিলেছে ফুলেল অভ্যর্থনা৷ সাংবাদিকদের গিজগিজে ভিড়, ক্যামেরার মুহুর্মুহু ফ্ল্যাশ, অজস্র টিভি ক্যামেরার পশ্চাৎধাবন আকবর আলীদের বুঝিয়ে দিয়েছে, শুধুই অনূর্ধ্ব-১৯ বয়সী ক্রিকেটারের সীমানা ছাড়িয়ে তারা প্রত্যেকে এখন জাতীয় বীর৷

গায়ে ‘ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নস’ খচিত বর্ণিল বাসে চড়ে বিমানবন্দর থেকে মিরপুরে বাংলাদেশের ‌‘হোম অব ক্রিকেট'মুখী আনন্দযাত্রা, সেখানে হাজারো মানুষের ভিড় আর মাঠের মাঝখানে সংবর্ধনা বুঝিয়েছে আরও ভালো করে৷ সেখানেই কি শেষ! পরদিন কেউ বিমানে, কেউ বা লঞ্চে নিজের ঠিকানায় ফিরে পেয়েছেন আরেক দফা সংবর্ধনা৷ টেলিভিশনে দেখছিলাম, গলায় ফুলের মাল্যশোভিত অধিনায়ক আকবর আলী খোলা জিপে দাঁড়িয়ে আবেগে উদ্বেল জনতার উদ্দেশে হাত নাড়তে নাড়তে সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে যাচ্ছেন রংপুরে নিজের বাড়িতে৷ কদিন আগের আমি আর এই আমি---ভোজবাজির মতো বদলে যাওয়া জীবন নিয়ে কোনো দার্শনিক ভাবনা কি উঁকি দিয়েছিল তাঁর মনে!

তবে অনেকের মনে ঠিকই উঁকি দিচ্ছে একটা দুশ্চিন্তা৷ কদিন আগেই নিজস্ব পরিমণ্ডলের বাইরে যাঁদের কেউ চিনত না, এমন মাতামাতিতে তাঁদের মাথা ঘুরে যাবে না তো! রাতারাতি এমন বিখ্যাত হয়ে যাওয়ার অবশ্যম্ভাবী সব পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সামলানোর ক্ষমতা আছে তো এই নবীনদের! প্রাণ খুলে আনন্দ করতে গেলে এমনিতেই একটু অস্বস্তির খচখচানি থাকে বাঙালির মনে৷ বিশ্বজয়ী এই তরুণ ক্রিকেটারদের নিয়ে সেটি আরও বেশি৷ নাহ্‌, এতটা করা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না৷ ছেলেগুলোর মাথা বিগড়ে যেতে বাধ্য৷

ভয়টা অমূলক নয়৷ কিন্তু কী-ইবা করার ছিল! আকবর আলীর দল অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের রানার্সআপ হয়ে ফেরার পর এমন কিছু করলে তা নিয়ে আপত্তি তোলা যেত৷ কিন্তু বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরও যদি দেশ আনন্দোৎসবে রঙিন না হয়, তাহলে আর কখন হবে! ক্রিকেটের সীমানা ছাড়িয়ে গিয়ে এটি তো বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসেরই সেরা অর্জন৷ মাতামাতি যা হয়েছে, হচ্ছে, সেটি তাই ঠিকই আছে৷ মাথা ঘুরে যাওয়ার ভয়? তা তো আছেই৷ থাকবেও৷ এই ভয়কে যাঁরা জয় করতে পারবেন, তাঁরাই টিকে থাকবেন, ঝরে যাবেন বাকিরা৷ এটাই জগতের রীতি৷

সেই ভয়ে আনন্দে বাঁধ দেওয়া কেন! সাফল্য পুরস্কার দাবি করে৷ স্বীকৃতি চায়৷ সেই পুরস্কার, সেই স্বীকৃতি একেকজনের মনে একেকভাবে কাজ করে৷ কারও মনে এটিই বুনে দেয় আরও বড় কিছু অর্জনের প্রতিজ্ঞা৷ খোলা জিপে ধাবমান মাল্যভূষিত আকবর আলীর তো এমন মনে হয়ে থাকতেই পারে যে, আমি আজ ছোটদের বিশ্বকাপ জিতে ফিরেছি৷ একদিন বড়দের বিশ্বকাপও এনে দেব দেশকে৷ এই বিশ্বকাপে আলো ছড়াতে না পারা কারও মন হয়তো শাণিত হয়েছে প্রতিজ্ঞায়-তেমন কিছু না করেই আমি এত কিছু পেয়েছি৷ সামনে আরও বড় কিছু করব৷

‌‘যা হলে ভালো', আমার মন কি তাহলে সেটিই শুধু বলে যাচ্ছে? তা কেন, উল্টোটাও যে হতে পারে, সেই আশঙ্কার কথা তো বললামই৷ ‘ধরাকে সরা জ্ঞান করা' প্রবাদটা এই দলের কারও কারও ক্ষেত্রে সত্যি হয়ে উঠতেই পারে৷ সেটি যাতে না হয়, তাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পরিবারের৷ সবচেয়ে বড় উদাহরণটা হাতের কাছেই পাচ্ছি৷ আকবর আলীরা তো উনিশে গিয়ে বিখ্যাত হলেন৷ শচীন টেন্ডুলকারের যে অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে পনের বছর বয়সেই৷ ১৬ বছর ২০৫ দিন বয়সে টেস্ট অভিষেকের অনেক আগে থেকেই পুরো ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছে বালক-বীরের নাম৷ যে খ্যাতি উত্তরোত্তর শুধু বেড়েই চলেছে৷ তারপরও টেন্ডুলকার টেন্ডুলকার হতে পেরেছেন মধ্যবিত্ত মূল্যবোধকে বুকে ধারণ করা এক পরিবারের ছায়া পেয়েছিলেন বলে৷ ছেলে পাকিস্তান সফর থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হয়ে ফেরার পর কবি ও মারাঠী সাহিত্যের অধ্যাপক খেলা নিয়ে একটা কথাও বলেননি৷ শুধু মনে করিয়ে দেন, আসল লড়াইটা মাঠের বাইরে৷ পা মাটিতে রেখে স্বপ্নটাকে ধাওয়া করা৷ সেটি করে গেছেন বলেই শচীন টেন্ডুলকার শচীন টেন্ডুলকার হতে পেরেছেন৷

বিপরীত উদাহরণ চান? সেটির জন্য শচীন টেন্ডুলকারের আশেপাশে তাকালেই চলছে৷ উদাহরণের নাম বিনোদ কাম্বলি, স্কুল ক্রিকেটে যাঁর সঙ্গে ৬৪৬ রানের জুটি বিশ্ব ক্রিকেটে প্রথম ছড়িয়ে দিয়েছিল টেন্ডুলকারের নাম৷ চার বছর পরে হলেও কাম্বলির টেস্ট ক্যারিয়ারের শুরুটা ছিল টেন্ডুলকারের চেয়েও সাড়ম্বর৷ কিন্তু অর্থ-খ্যাতি আর এর হাত ধরে আসা নানাবিধ প্রলোভন থেকে কাম্বলিকে রক্ষা করার জন্য টেন্ডুলকারের মতো পারিবারিক বর্ম ছিল না৷ এই দুজনের বিপরীতমুখী যাত্রা দেখে আমার মনে তাই প্রায়ই একটা প্রশ্ন জাগে, ছেলের তারকাখ্যাতিতে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া কাম্বলির হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম হলে কি টেন্ডুলকার টেন্ডুলকার হতে পারতেন? উল্টো করে বললে বাবা রমেশ টেন্ডুলকারের মতো বাবা আর অজিত টেন্ডুলকারের মতো ভাই পেলে কি অন্যরকম হতো বিনোদ কাম্বলির গল্পটা?

এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না৷ কী করলে বা কী না করলে তরুণ প্রতিভা পরিপূর্ণ বিকশিত হবে, সেটিরও যেমন না৷ ধরাবাঁধা কোনো ফর্মুলা নেই যে৷

একটা কথা মনে হয় আগেই পরিষ্কার করে নেওয়া উচিত ছিল৷ অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে ভালো খেলাটা মোটেই সফল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হওয়ার নিশ্চয়তা নয়৷ এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রবেশাধিকার পাওয়ারও নয়৷ মাঝখানে খানাখন্দে ভরা দুর্গম পথ৷ বিশ্বকাপজয়ী এই দলটির আগে বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে যত ক্রিকেটার খেলেছেন, তার মাত্র ৩৫ শতাংশের মতো যেটি পেরোতে পেরেছেন৷ এই দলের ক্রিকেটারদের নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রতিশ্রুত দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে অঙ্কটা হয়তো একটু বাড়বে৷ কিন্তু অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে বিশ্বসেরা দলের সদস্য বলে এঁদের সবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হওয়ার ছাড়পত্র পেয়ে গেছেন, ব্যাপারটা মোটেই এমন নয়৷ কেউ তা না পেলে বিশ্বকাপ জয়ের পর মাতামাতিকেই সর্বনাশের একমাত্র কারণ হিসাবে ধরে নেবেন না যেন৷

তরুণ ক্রিকেটারদের মাথা ঘুরে যাওয়ার যে ভয় নিয়ে এত কথা, সেই প্রসঙ্গে একটা গল্প খুব প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে৷ গল্পের নায়ক অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতেই প্রথম বিখ্যাত হয়েছিলেন৷ দলের অধিনায়ক ছিলেন বলে বাকিদের চেয়ে একটু বেশিই৷ সেই হঠাৎ বিখ্যাত হয়ে যাওয়া সত্যি সত্যি তাঁর মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল৷ বেহিসেবি উদ্দাম জীবনে হারিয়ে যেতে বসেছিল ক্রিকেটের প্রতি নিবেদন৷ যা দেখে ছেলেবেলার কোচ একদিন তাঁকে একান্তে ডেকে নিয়ে বলেন, ‌‘‘এই শহরে তোমার মতো বা তোমার চেয়ে সুদর্শন কয়েক লাখ ছেলে আছে৷ এই যে সবাই তোমাকে এমন মাথায় করে রাখে, মেয়েরা তোমার সঙ্গ পেতে ব্যাকুল, সেটির মূল কারণ কিন্তু তুমি ক্রিকেটটা ভালো খেলো৷ ওটা না থাকলে এসব কিছুই থাকবে না৷'' শোনা যায়, কোচের ওই কথার পরই অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কের জীবন দর্শনে আমূল পরিবর্তন আসে৷ ফিটনেস, খাদ্যাভ্যাস, অনুশীলন আর নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার নিরন্তর সাধনার নিরিখে এখন যিনি বিশ্ব ক্রিকেটেরই এক রোল মডেল৷ নাম বললেই যাঁকে আপনারা সবাই চিনে ফেলবেন৷ বিরাট কোহলি৷

Utpal Shuvro, renowned Sports Journalist of Bangladesh.
উৎপল শুভ্র, ক্রীড়া সাংবাদিকছবি: privat

পরিবারের ভূমিকার কথা তো আগেই বললাম৷ আকবর আলীদের আশেপাশে এমন কোচ থাকাটাও জরুরি৷ কোচই হতে হবে, এমন নয়৷ বন্ধু হতে পারেন, চাচা-মামা, নির্বাচক বা বোর্ড কর্মকর্তা..৷ যাঁরা এই তরুণদের মনে করিয়ে দেবেন, চারপাশে যত কিছুই হোক, ক্রিকেটটা ঠিক রাখতে হবে৷ সেটি ঠিক থাকলে বাকি সব এমনিতেই হবে৷ সবাই যে তা বেদবাক্যের মতো মেনে নেবেন, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই৷ না নিলে সেটির মূল্য তাঁদেরকেই দিতে হবে৷ এটাই জগতের রীতি৷ সেই ভয়ে আমরা আনন্দ করব না, বিশ্ব জয় করে আসা তরুণদের উপহারে-ভালোবাসায় ভরিয়ে দেব না---এটা হয় নাকি!