1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বস্তিই কলকাতার বিপদ বাড়াচ্ছে?‌

১৫ জানুয়ারি ২০২১

উত্তর কলকাতার ঘনবসতি বাগবাজার অঞ্চলের সাম্প্রতিক আগুন আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, কীভাবে জতুগৃহ হয়ে আছে শহর৷

https://p.dw.com/p/3nxTG
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/D. Chakraborty

শহরের জনবহুল বসতি অঞ্চলে আগুন লাগলে যা যা অসুবিধে হওয়া সম্ভব, সব হয়েছে বুধবার সন্ধ্যায় উত্তর কলকাতার বাগবাজার এলাকার এক বস্তির বিধ্বংসি আগুনে৷ কমবেশি শ'‌খানেক বাড়ি পুড়ে খাক হয়েছে৷ দমকলের ২৫টি ইঞ্জিন সংকীর্ণ রাস্তায় ঢুকতে পারেনি বলে দূরত্বে থেকে আগুন নেভানোর কাজ করতে গিয়ে নাজেহাল হয়েছে৷ বস্তির লাগোয়া রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রকাশনা দপ্তর উদ্বোধন কার্যালয়ের একটা অংশে আগুন ছড়িয়ে পড়ে বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য পুঁথি এবং নথিপত্র পুড়ে নষ্ট হয়েছে৷ একটাই বাঁচোয়া, যে এই আগুনে কেউ হতাহত হয়নি৷ কিন্তু একটা জরুরি প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেছে এই দুর্ঘটনা যে শহরের মাঝখানে এই ধরনের বিনা অনুমতিতে, পরিকল্পনাহীনভাবে গড়ে ওঠা জনবসত আর কতদিন গোটা শহরের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে থাকবে?‌
কলকাতায় যখনই কোনও বাজারে আগুন লাগে, তিনটি কারণ প্রতিবারই সামনে আসে৷ আগুন নেভানোর উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকা, দমকলের বৈধ ছাড়পত্র ছাড়াই দাহ্য বস্তু মজুত রাখা এবং ত্রুটিপূর্ণ ইলেকট্রিকাল ওয়্যারিং৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বহুতলে আগুন লাগে ত্রুটিযুক্ত বৈদ্যুতিক সংযোগ ব্যবস্থায় শর্ট সার্কিট থেকে৷ আর ছড়িয়ে থাকা বস্তি এলাকার ক্ষেত্রে এর সঙ্গে যোগ হয় পরিকল্পনাবিহীন নির্মাণ এবং বাসিন্দাদের নেহাত বেপরোয়া মনোভাব৷ বাগবাজারের আগুনের ক্ষেত্রেও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, একের পর এক এলপিজি সিলিন্ডার বিষ্ফোরণের বিকট শব্দ পাওয়া গেছে, যা রাখা ছিল গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকা এক বা দেড় কামরার ঘরের প্রায় প্রতিটিতে৷ ফলে আগুন ইন্ধন পেয়ে আরও ব্যাপক, আরও তীব্র হয়েছে৷
ওই অঞ্চলেরই বাসিন্দা শৈবাল বিশ্বাস জানালেন, যে বস্তিতে এই আগুন, তার পুরোটাই জবরদখল এলাকা৷ জমির আসল মালিকরা মামলা মকদ্দমায় ব্যস্ত থাকার সুযোগ নিয়ে, সুন্দরবন থেকে উৎখাত হয়ে আসা কিছু পরিবার এই জমিতে থাকতে শুরু করে গত আশির দশকে৷ শহর ঘুরে চ্যালা কাঠ বিক্রি করা, রিকশা এবং ভ্যান–রিকশা চালানো থেকে শুরু করে মামুলি কাজ করত পুরুষেরা এবং মেয়েরা আশপাশের বাড়িতে রান্না, বাসন মাজা, কাপড় কাচার মতো কাজ করত৷ এই করেই তারা এলাকার অর্থনৈতিক ইকোসিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়, যে বাঁধন আর ছাড়ানো যায়নি৷ একদিকে তথাকথিত ‘‌ছোট কাজ'‌ করার জন্য অনেক জোড়া হাত যেমন শহুরে পরিবারগুলির দরকার ছিল, ওই ছিন্নমূল মানুষগুলোরও প্রয়োজন ছিল জীবিকার নিশ্চিত সংস্থানের৷
কিন্তু সরকার কি কখনও চেষ্টা করেনি এই জবরদখল উচ্ছেদের?‌ শৈবালবাবু জানালেন, বামফ্রন্ট আমলে এই বস্তি উঠিয়ে ওখানে বাস গুমটি তৈরির একটা চেষ্টা প্রাক্তন পরিবহণমন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী করেছিলেন৷ সরকারের পরিকল্পনা ছিল, ব্যক্তি মালিকের হাত থেকে জমিটি কিনে নিয়ে সরকারি এবং বেসরকারি বাসের দাঁড়াবার জায়গা ওখানে হবে৷ ‘‌‘‌কিন্তু চেষ্টা সফল হয়নি, কারণ ওরা উদ্বাস্তু, ছিন্নমূল— এটাকে সামনে রেখে বেশ কয়েকটা সংগঠন, তার মধ্যে কিছু এনজিও–ও আছে, তারা এগিয়ে আসে এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলা৷ এমন সমবেতভাবে একটা রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলায় বামফ্রন্ট সরকার দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে৷ পিছিয়ে আসে৷ তা ছাড়া মানুষের মধ্যে একটা দরদও ছিল, যে জবরদখল করলেও আসলে তো গরিব মানুষ!‌ এদের উৎখাত করাটা ঠিক হবে না৷’’
এর পরেই যেটা হয়, যে এই জনবসতিকে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করতে এদের ঢালাও রেশন কার্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা৷ ফলে এই জবরদখল এক ধরনের বৈধতা পেয়ে যায়৷ এবং বৈধ স্থায়ী ঠিকানা না থাকা সত্বেও এলপিজি গ্যাসের গ্রাহক হওয়া থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের হাই টেনশন লাইন থেকে হুকিং–এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ চুরি করা, সেই চোরাই বিদ্যুতে আলো, পাখা, টিভি, ফ্রিজ, সবই চালানো ন্যায়সঙ্গত হয়ে যায়৷ ঘটনা হলো, কলকাতা শহরে এমন জবরদখল এলাকা অনেক আছে, যেখানকার বাসিন্দারা বেআইনিভাবেই নাগরিক জীবনের সব রকম সুবিধে নিয়ে থাকেন এবং দায় পড়লে সরকারি প্রকল্পের রাস্তাতেও বাধা হয়ে ওঠেন৷ সাম্প্রতিক অতীতে কলকাতার মেট্রো রেল প্রকল্পের কাজ শহরের কিছু এলাকায় ঠিক এই কারণেই দীর্ঘ সময় আটকে থেকেছে৷
মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ঘোষণা করেছেন, বাগবাজারের অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের ঘর নতুন করে গড়ে দেবে তাঁর সরকার৷ কিন্তু তিনি তাঁদের অন্যত্র পুনর্বাসন দেবেন, না ভোটের বছরে পুরনো বস্তিই নতুন করে তৈরি করে শহরের বিপদ জিইয়ে রাখবেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়৷

‘মানুষের মধ্যে একটা দরদও ছিল’