‘ব়্যাবের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে কমিশনের আইনে বাধা আছে'
৪ নভেম্বর ২০২২এসব বিষয় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান৷
ডয়চে ভেলে : নির্বাচন এলেই জঙ্গি বিরোধী অভিযান জোরদার হয়৷ আসলেই কি জঙ্গিদের তৎপরতা বাড়ে? নাকি এটা বড় করে দেখানো হয়?
অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান : নির্বাচন যখন এগিয়ে আসে তখন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের বিস্তৃতি লাভ করে৷ তারা অনেক বেশি সক্রিয় হন৷ নির্বাচনের সময় যে-কোনো সরকারই একটু চাপে থাকে৷ গণতান্ত্রিক সুযোগ সুবিধা বাধাগ্রস্ত হয় এমন কিছু করতে সরকার একটু দ্বিধাগ্রস্ত থাকে৷ এই সুযোগটাই সুযোগসন্ধানী গ্রুপ কাজে লাগাতে চায়৷ জঙ্গি গোষ্ঠীও এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করে৷ এটা শুধু বড় করে দেখানো, তা কিন্তু নয়৷
অনেকেই অভিযোগ করেন, ব়্যাব কিছু সাজানো কার্যক্রম চালায়৷ এই অভিযোগগুলো কেন উঠে?
জনগণের মধ্যে ব়্যাবের একটা ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে যে, ব়্যাব একটা এলিট ফোর্স৷ অলমোস্ট এটা একটা প্যারা মিলিটারি ফোর্স৷ প্রথম থেকেই এমন একটা ভাবমূর্তি গড়ার চেষ্টা করা হয়েছে৷ কিছুটা হলেও গড়ে উঠেছে৷ অনেক সময় ব়্যাব আইন-বহির্ভূতভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করে৷ যাদের বিরুদ্ধে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে তারা কিন্তু সমাজে সমাদৃত ব্যক্তি নয়৷ এর জন্য হয় কি, দেশে আইনের শাসন কেন প্রয়োজন, আইনের শাসন ছাড়া একটা সভ্য সমাজ কেন চলতে পারে না, এই তাত্ত্বিক বিষয়গুলো যাদের খুব একটা ধরে না, তারা এই মুহূর্তে কী পেলাম তাতে সন্তুষ্ট থাকতে চায়৷ ব়্যাব অপরাধী বা গুন্ডা বদমাইশদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে, এতে এলাকাবাসী একটা সুফল পায়, এতে সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদের গ্রহণযোগ্যতা লক্ষ্য করা যায়৷ এটাকেই ব্যবহার করে তারা অনেক সময় আইন-বহির্ভূতভাবে কাজ করে৷ তারা জানে যে, জনগণের একটা মৌন সমর্থন তাদের উপর রয়েছে, সেহেতু এটা করেও পার পাওয়া যাবে৷ তারা আইনের শাসনকে অবজ্ঞা করছে৷ এতে তাদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা সেটা হয় না৷ সেই দিক থেকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের দায়মুক্তি দেওয়া আছে৷ জনগণের একটা সমর্থন যেহেতু তাদের রয়েছে তাই সেই সুবিধাটা ব়্যাব অনেক সময় ব্যবহার করে থাকে৷
দেশীয় বা আন্তর্জাতিক সমালোচনায় ব়্যাব কি কোনো সংকটে পড়েছে?
এটাতে যে আমাদের সাংঘাতিক কোনো সমস্যা হয়েছে তা কিন্তু নয়৷ তাদের উপর যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সেটা কিন্তু সাম্প্রতিক কোনো কাজের জন্য নয়৷ অতীতের কার্যক্রম বিবেচনা করে এটা দেওয়া হয়েছে৷ অতীতের কারণে বর্তমানে শাস্তি দেওয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত হয়েছে সেটা যারা দিয়েছেন তারা বলতে পারবেন৷ আমরা যারা মানবাধিকার কর্মী আছি, আমাদের কাছে মনে হয়, পশ্চিমা অনেক রাষ্ট্র বা সংস্থা তাদের মধ্যে মানবাধিকারকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা রয়েছে৷ এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয়৷ আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোতে যখন সাধারণ নির্বাচন ঘনিয়ে আসে তখন পশ্চিমা অনেক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র তাদের ইচ্ছা এবং অনিচ্ছা রাষ্ট্রের উপর চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ খোঁজে এবং এই সময়টাকে তারা বেছে নেয়৷ মানবাধিকারের বিষয়টি তারা তখন কোনো রাষ্ট্রের উপর চাপিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে সচেষ্ট থাকে৷ এ ব্যাপারে আমাদের যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে, অভিজ্ঞতাও কম নয়৷ ফলে আমরা বুঝতে পারি কোনটা আসলেই মানবাধিকারের জন্য, আর কোনটা মানবাধিকারকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে অন্য কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য৷ এই পার্থক্যটা নির্ণয় করা এখন খুব একটা কঠিন বিষয় না৷
অনেকেই বলছেন, ব়্যাব ভাবমূর্তি বাড়ানোর জন্য সম্প্রতি জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমকে বড় করে দেখাচ্ছে৷ আসলে কি তাই?
জঙ্গি কারা, জঙ্গি কী এই সংজ্ঞাগুলো খুবই সাবজেকটিভ৷ আপনার কাছে যে জঙ্গি, আমার কাছে সে জঙ্গি নাও হতে পারে৷ পশ্চিমের কাছে যে জঙ্গি, পূর্বের কাছে সে জঙ্গি নাও হতে পারে৷ ইসলামি রাষ্ট্রের কাছে যে জঙ্গি, অন্য রাষ্ট্রের কাছে সে জঙ্গি নাও হতে পারে৷ জঙ্গি বললে আমাদের মধ্যে যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয় এবং জঙ্গি নির্মূলে প্রতিটি মানুষই আকাঙ্খা পোষণ করে সেটাকেই কাজে লাগানো হয়৷ পশ্চিমা থেকে শুরু হওয়া জঙ্গিবিরোধী যে আগ্রাসী কার্যক্রম সেটা যখন অন্য কোনো রাষ্ট্র শুরু করে তখন তাদের পক্ষে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয় না৷ পশ্চিমারা অনেক সময় জঙ্গিকে উছিলা বানিয়ে অন্যান্য নানা স্বার্থে ব্যবহার করে, ঠিক তেমনি তৃতীয় বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র পশ্চিমাদের এই মঞ্চটাকে ব্যবহার করে তারা তাদের হাতকে কিছুটা শক্তিশালী করে এবং বিরোধী মতাদর্শকে চাপে রাখতে কৌশলটা নেয়৷
আপনি যখন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন, তখন কি ব়্যাবের কোনো কার্যক্রম নিয়ে তদন্ত করেছেন?
ব়্যাবের বিরুদ্ধে সরাসরি তদন্ত করতে মানবাধিকার কমিশনের আইনে বিধিনিষেধ রয়েছে৷ তারপরও আমরা তথ্যানুসন্ধানের নামে ব়্যাবের বেশ কয়েকটি কাজের অনুসন্ধান করেছি৷ আমাদের যে ফাইন্ডিংস সেটা আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি৷ এতে করে ব়্যাব কিন্তু অনেকগুলো ঘটনার পুনরায় তদন্ত করতে বাধ্য হয়েছে৷ সেখানে কিন্তু আমাদের যে ফাইন্ডিংস সেটা ব়্যাবের তদন্তেও এসেছে৷ আমরা সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছি৷
ব়্যাবের কর্মকর্তারাও তো ভুল করেন, সেই ভুলের শাস্তির কথা আপনি বলছিলেন৷ সেই শাস্তি তারা প্রকাশ করে না কেন? এটা চেপে রেখে তাদের লাভ কী?
এটা একেবারেই সত্যি৷ তারা সেই শাস্তি প্রকাশ করেন না এই কারণে যে, তারা মনে করেন, এটা প্রকাশ করলে তাদের যে দৃঢ়তা সেখানে ফোর্সের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হতে পারে৷ আমরা মনে করি, এটা জনসম্মুখে প্রকাশ করা উচিত৷ এতে জনগণের সামনে তাদের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হবার সম্ভাবনা থাকে৷ ব়্যাবের নিজের স্বার্থে এবং আইনের শাসনের স্বার্থে এই কাজগুলো পাবলিক করা উচিত বলে আমি মনে করি৷
ব়্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পুরনো৷ আপনি যখন কমিশনে ছিলেন তখন কি এগুলো নিয়ে ব়্যাবের সঙ্গে আলোচনা করেছেন?
হ্যাঁ, আমি করেছি৷ আমি দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পর ব়্যাবের মহাপরিচালককে আমার অফিসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম৷ তিনি এসেছিলেন৷ তার সঙ্গে আমার রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়েছে৷ আমাদের কাছে তখন অনেকগুলো অভিযোগ ছিল৷ সেগুলো তাকে দিয়ে আমরা ব্যাখ্যাও চেয়েছিলাম৷ এভাবে খোলামেলা অনেক আলাপ হয়েছে৷ এমনকি তনু হত্যাকাণ্ডের পর ব়্যাবের সঙ্গে আমার খোলামেলা কথা হয়েছে৷ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আমার সঙ্গে তাদের কথা হয়েছে৷ এর যে সুফল আমরা পাইনি এটা বলা যাবে না৷ কিছুটা সুফল নিশ্চয় আমরা আদায় করতে সক্ষম হয়েছি৷
ব়্যাবের বানানো ‘অপারেশন সুন্দরবন' ছবিটি দেখানোর আয়োজন করতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়কে ব়্যাব অনুরোধ করেছে, এটা প্রয়োজন হলো কেন?
ব়্যাব যখন প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী করে তখন তারা একটা তথ্যচিত্র করে৷ তখন সেটা দেখানো কিন্তু একরকম বার্তা৷ কিন্তু তারা একটি তথ্যচিত্র করে যখন বিশ্ববিদ্যালয়কে বলে এটা দেখানো হোক, এই কৌশলটাই ভুল৷ এতে উপকারের চেয়ে অপকার বেশি হয়৷ তখন মানুষের মধ্যে ভুল বার্তা যায়৷ নেতিবাচক ধারণা পাকাপোক্ত হয়৷ এগুলো সুচিন্তিত পদক্ষেপ নয়, কৌশল নয়৷ তারা যদি কোনো ভালকাজ করেন সেটা প্রকাশ করার জন্য গণমাধ্যমের চেয়ে ভালো কোনো মাধ্যম আছে বলে আমার মনে হয় না৷ সেই স্বীকৃতি যদি গণমাধ্যমের কাছ থেকে আদায় করা যায় তার চেয়ে ভালো কোনো পন্থা আছে বলে আমার মনে হয় না৷