বাংলাদেশ কি গমের সংকট এড়াতে পারবে?
১৫ মে ২০২২সাধারণত ইউক্রেন ও রাশিয়া বাংলাদেশের গম আমদানির শীর্ষ দেশ হলেও যুদ্ধ শুরুর পর গত মার্চ থেকে সেই জায়গায় উঠে এসেছে ভারত৷ কিন্তু এখন প্রতিবেশী দেশটি থেকেও গম না পেলে পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দিবে বাংলাদেশ সেটি বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে৷
চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশকে দ্রুত বিকল্প বাজার খোঁজার তাগিদ দিয়েছেন বেসরকারি খাতের গম আমদানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা৷ কিন্তু সমস্যা হলো ভারতের তুলনায় ক্যানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অষ্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য দেশে গমের দাম বেশি৷ তাই সেখান থেকে গম আনলে দাম অনেক বেশি পড়বে৷
বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে যারা গম আমদানি করে তাদের মধ্যে টিকে গ্রুপ অন্যতম৷ এই গ্রুপের ঊর্ধ্বতন পরিচালক তারিক আহমদে বলেন, ‘‘গমের বিকল্প উৎস আছে কিন্তু দাম অনেক বেশি৷ ভারতে যেমন এখন প্রতিটন ৪০০ ইউএস ডলার৷ কিন্তু ক্যানডায় ৫৪০ ইউএস ডলার৷ অষ্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানির গমের দামও বেশি। দামের তুলনা করলে এই সময়ে ভারতের কোনো বিকল্প দেখা যাচ্ছে না৷ আমরা যা শুনেছি তাতে ভারতের গম সরকার টু সরকার হয়তো আমদানি করা যাবে৷’’
ভারত গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করলেও এখন পর্যন্ত যে এলসি খোলা হয়েছে সেই গম সরবরাহ করা হবে বলে জানা গেছে৷ এছাড়া কোনো দেশ খাদ্য সংকটে পড়লে ভারত সরকার চাইলে সেই দেশে গম রপ্তানির আদেশ দিতে পারে৷ প্রতিবেশি দেশগুলোর জন্য তারা সরকারি পর্যায়ে গম রপ্তানির একটা ব্যবস্থাপনাও রেখেছে৷
বাংলাদেশের খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ভারত থেকে তিন লাখ টন গম আনার জন্য এরইমধ্যে চুক্তি করা হয়েছে৷ যার মধ্যে এক লাখ টন মঙ্গলবার আসার কথা৷
মজুত সংকট নেই
বাংলাদেশে এখন বছরে গমের চাহিদা ৭৫ লাখ টন৷ এর মধ্যে দেশে উৎপাদন হয় ১১ লাখ টন৷ সাধারণত রাশিয়া, ইউক্রেন, ক্যানাডা ও ভারত থেকে আমদানি করে বাকি ঘাটতি মেটানো হয়৷
গত অর্থবছরে মোট আমদানি করা গমের মধ্যে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে শতকরা ৪৫ ভাগ, ক্যানাডা থেকে ২৩ ভাগ এবং ভারত থেকে ১৭ ভাগ গম আমদানি করা হয়েছে৷ বাকি ১৫ ভাগ গম আমদানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা ও অষ্ট্রেলিয়াসহ আটটি দেশ থেকে৷ ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আমদানিচিত্র পাল্টে যায়৷ ১ মার্চ থেকে ১২ মে পর্যন্ত গম আমদানির যে হিসাব তাতে ভারত শীর্ষে আছে৷ এই সময়ে ছয় লাখ ৮৭ হাজার টন গম আমদানি করা হয়৷ যার মধ্যে ভারত থেকে শতকরা ৬৩ ভাগ, ক্যানাডা থেকে ১৪ ভাগ আর অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা হয় ২৩ ভাগ৷
খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ৫৫ লাখ ৪৬ হাজার টন গম আমদানি হয়েছে৷ এর আগে ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আমদানি হয়েছিল ৫৩ লাখ ৪২ হাজার টন৷
বাংলাদেশে বেসরকারি খাত ছাড়াও সরকার তার বিভিন্ন কাজের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্পের জন্যও গম আমদানি করে৷ গত অর্থ বছরে সরকার সরাসরি গম আমদানি করেছে প্রায় চার লাখ ৫০ হাজার টন৷ চলতি অর্থ বছরে এপর্যন্ত আমদানি করেছে চার লাখ ৭৮ হাজার টন৷ বর্তমানে সরকারের কাছে মজুত আছে এক দশমিক এক-আট লাখ টন গম৷
বাড়ছে দাম
বাংলাদেশে চালের বিপরীতে খাদ্য হিসেবে গমের ব্যবহার বাড়ছে৷ এখন বছরে তিন কোটি ৫০ লাখ টন চালের চাহিদার বিপরীতে গমের চাহিদা ৭৫ লাখ টন৷ গমের আটা ও ময়দা থেকে রুটি ছাড়াও নানা ধরনের ব্রেড, বিস্কুট ও বেকারি পণ্য তৈরি হয়৷ এসব খাদ্য পণ্যের উপর নির্ভর করেন নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ৷
উইক্রেন যুদ্ধের কারণে এরইমধ্যে আটা ময়দার দামে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে৷ এক বছর আগের চেয়ে কেজিতে প্যাকেটজাত আটার দাম ১০ টাকা আর ময়দায় বেড়েছে ২০ টাকার মতো৷ টিকে গ্রুপের ঊর্ধ্বতন পরিচালক তারিক আহমদে বলেন, ‘‘ইউক্রেন যুদ্ধের আগে গত বছরের দামের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় গমের আমদানি মূল্য দ্বিগুণ হয়ে গেছে৷ তখন ভারতের গম ছিলো প্রতি টন ২০০ ডলার, ক্যানাডার ২৮০ ডলার৷ বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত গমের পর্যাপ্ত মজুত থকলেও এরই মধ্যে আটা ও ময়দার দাম বেড়ে গেছে৷ প্যাকেটজাত আটার দাম প্রতি কেজি ৪৭ টাকা এবং ময়দা ৬৫ টাকা৷ কিন্তু গত বছরের শেষ দিকে আটা ছিলো ৩৫ টাকা এবং ময়দা ৪৫ টাকা কেজি৷’’
সিপিডির অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, ‘‘ভারত থেকে সরকারি পর্যায়ে গম আমাদানির চেষ্টা ছাড়াও বাংলাদেশকে ভবিষ্যৎ বাজার নিয়ে চিন্তা করতে হবে৷ বিকল্প উৎস থেকে গম আমদানির চেষ্টা করতে হবে৷ তবে ভোক্তাদেরও বেশি দামে কেনার জন্য মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে৷ কারণ এই সংকট এখন বিশ্বব্যাপী৷’’
তবে সরবরাহ স্থিতিশীল রাখতে তিনি সরকারের তৎপরতার ওপরও জোর দেন৷ ভোজ্য তেলের মতো সরবরাহ ব্যবস্থা যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে নজর রাখার পরামর্শ দিয়েছেন৷ ‘‘সরকাররে বাণিজ্য এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়কে এখনই আমদানিকারকদের সাথে বসতে হবে৷ বসে মজুতের অবস্থা, আমদানি পরিস্থিতি সবকিছু পর্যালোচনা করতে হবে৷ আর সরকার উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্য যে গম আমদানি করে সেটাও বাড়াতে পারে৷ এসব করতে হবে সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে,’’ বলেন এই অর্থনীতিবিদ৷
এদিকে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সিলেটে খাদ্য গুদাম পরিদর্শনে গিয়ে রোববার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘‘ভারত বেসরকারি পর্যায়ে গম রপ্তানি বন্ধ করেছে, সরকারি পর্যায়ে করেনি৷ আমরা সম্প্রতি ভারত থেকে তিন লাখ টন গম আমদানির চুক্তি করেছি৷ আর এখন তারা হয়তো বন্ধ করেছে, ১০ দিন পর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে৷ এটা নিয়ে কোনো সংকট হবে বলে মনে করি না৷’’