‘বাংলাদেশে এখনো অনেক শিশু অধিকার-বঞ্চিত’
২৮ এপ্রিল ২০২৩ডয়চে ভেলে : আমাদের দেশের শিশুরা আসলে কতটা অধিকার ভোগ করে?
ড. মো. এনামুল হক : যে অর্থে আমরা অধিকার ভোগ বলি, সেখানে আমরা যদি দেশে শিশুদের চিত্রটা দেখি, তাহলে বলবো, অধিকার যতটুকু দেওয়ার কথা, ততটুকু দিতে পারছি না৷ বিশেষ করে আমরা যাদের নিয়ে কাজ করি, সেই এতিম শিশুদের সংখ্যাটা হয়ত আমি বলতে পারবো না৷ তবে আমরা এই শিশুদের অধিকারটা পুরোপুরি দেওয়ার চেষ্টা করি৷ যদি আমি সার্বিক চিত্রের কথা বলি, তাহলে এখনো দেখবো রাস্তা-ঘাটে অনেক শিশু আছে৷ তারা অধিকার-বঞ্চিত হচ্ছে৷ শিশুশ্রম আছে৷ যদিও সংখ্যাটা এখন কমে এসেছে৷ অনেক রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে শিশুরা আছে৷ এসব ক্ষেত্রেও তো শিশুদের অধিকারের লঙ্ঘন হচ্ছে৷ আমরা অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছি৷ আমরা চেষ্টা করছি, এগুলোকে সামনে আনতে৷ সবমিলিয়ে আমি বলবো, এখনো অনেক শিশু অধিকার-বঞ্চিত৷
আমরা তো এখনো দেখছি, শিশুরা সহিংসতার শিকার হচ্ছে৷ এ ব্যাপারে সরকার বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কী করছে?
এটা সত্যি যে শিশুরা সহিংসতার শিকার হচ্ছে৷ এজন্য আমরাসহ অনেক বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সরকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছে৷ আমরা সরকারী ফোরামে বারবার আলোচনা করেছি, শিশুদের অধিকার বা সুরক্ষার জন্য যদি আলাদা একটা শিশু অধিদপ্তর করা যায়৷ এটা নিয়ে অনেকদিন ধরেই আমরা বলছি৷ সরকারের নীতিনির্ধারকরাও এটা নিয়ে চিন্তা করছে৷ কিন্তু একটু স্লো৷ এখানে আমাদের আরো কিছু করার সুযোগ আছে৷
সহিংসতার শিকার হওয়া শিশুদের পাশে আপনারা কীভাবে দাঁড়ান?
এক্ষেত্রে আমরা হয়ত সরাসরি কিছু করতে পারি না৷ তবে অ্যাডভোকেসি করে থাকি৷ পাশাপাশি সচেতনতামূলক কাজগুলো আমরা করি৷ শিশুরা সহিংসতার শিকার হলে তাদের ভবিষ্যতে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে সেসব বিষয়ে আমরা সচেতনামূলক কাজ করি৷ আমরা রাউন্ড টেবিল করি৷ স্কুলগুলোতেও আমরা আলাপ করি, শিশুরা সহিংসতার শিকার হলে বা যাতে সহিংসতার শিকার না হয় এর জন্য কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায়৷ এসব নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়েও আমরা কাজ করি৷
অধিকার-বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে তো আপনারা কাজ করেন৷ এই মুহূর্তে দেশে কত শিশু অধিকার-বঞ্চিত? পাশাপাশি আপনাদের কাজগুলো কী?
সত্যিকার অর্থে এই মুহূর্তে সংখ্যাটা হয়ত বলতে পারবো না৷ তবে আমরা ১৯৭২ সাল থেকে এতিম শিশুদের নিয়ে কাজ করছি৷ এরাই তো আসলে সবচেয়ে বেশি অধিকার-বঞ্চিত শিশু৷ এই মুহূর্তে ১৫-১৬ হাজার শিশু আমাদের তত্ত্বাবধানে আছে৷ আমরা যে কাজটি করি, একটা শিশুকে পারিবারিক আবহ দিয়ে বড় করা, যাতে সে মায়ের ভালোবাসা পায়, ভাই-বোনের ভালোবাসা পায়৷ সামাজিক বন্ধনের বিষয়টিতে আমরা জোর দেই৷ এই কারণে কমিউনিটি লেভেলে আমরা চেষ্টা করি, বাবা-মায়ের সঙ্গেই যেন সে বড় হতে পারে৷ এছাড়া শিশুদের নিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করে, তাদের সঙ্গেও আমরা যৌথভাবে এগুলো নিয়ে কাজ করি৷ আমাদের কাজটা হলো, অধিকার-বঞ্চিত শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা৷ এক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গেও আমাদের নিবিড় সম্পর্ক আছে৷
এই শিশুদের আপনারা কীভাবে খুঁজে বের করেন? নাকি কারো মাধ্যমে খবর আসে?
আমরা নিজেরাও খুঁজে বের করি৷ পাশাপাশি সমাজসেবা অধিদপ্তরের সারাদেশে যে কার্যালয়গুলো আছে তারাও অনেক সময় আমাদের কাছে পাঠান৷ এছাড়া সরকারের যে অর্ফানেজগুলো আছে, যেমন ঢাকায় ছোটমনি নিবাস, বেবি হোম এসব জায়গা থেকেও আমরা শিশুদের পাই৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও আমাদের কাছে পাঠায়৷ আমাদের কাছে বেশ কয়েকটি উদাহরণ আছে৷ কোর্ট থেকে অনেক সময় আমাদের কাছে পাঠানো হয়৷ সম্প্রতি সৌদি আরব থেকে আসা চারটা শিশু আমাদের কাছে দেওয়ার কথা ছিল৷ পরে অবশ্য সরকারের মধ্যস্থতায় তারা পরিবারেই ঠাঁই পেয়েছে৷ আমরা চেষ্টা করি একটা শিশুকে তার পরিবারে রেখেই সাপোর্ট করতে৷ একেবারে যদি কোনো পথ না থাকে তারপর আমরা শিশুটিকে চিলড্রেন ভিলেজে নিয়ে আসি৷
পথশিশুদের পুষ্টিহীনতা দূর করার কোনো উদ্যোগ আপনাদের বা সরকারীভাবে আছে?
পুষ্টিহীনতা দূর করতে সরকারের তো বিভিন্ন প্রোগ্রাম আছে৷ বিশেষ করে মিট ডে মিল প্রোগ্রাম৷ এটা খুব সুন্দর একটা প্রোগ্রাম৷ যদিও আমরা এটা অনেক আগে থেকেই করি৷ মিট ডে মিল চালু করার ফলে স্কুল ড্রপ আউট একেবারেই শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে৷ আগে যেসব শিশু খাবারের অভাবে স্কুলে যেতে পারত না, মিট ডে মিল প্রোগ্রাম চালু করার ফলে স্কুলে উপস্থিতি অনেক বেড়ে গেছে৷ এটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও করছে৷ আমরা এই মুহুর্তে ৬টি এলাকায় ১০ থেকে ১৫ হাজার শিশুর খাদ্য ও শিক্ষার ব্যবস্থা করে যাচ্ছি৷
দেশে শিশু মৃত্যুর হার কি কমছে?
সত্যিকার অর্থেই আগের তুলনায় শিশু মৃত্যুর হার কমছে৷ এর অনেকগুলো কারণ আছে৷ আমরা যদি বলি, প্রাইমারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অনেক ভালো হয়েছে৷ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে৷ সরকারের ইপিআই প্রোগ্রামটা অনেকবেশি সফল হয়েছে৷ এসব কারণে শিশু মৃত্যুর হার অনেক কম৷
দেশে শিশুদের চিকিৎসা-সেবা কি পর্যাপ্ত?
আমি বলবো, এটা আসলে যথেষ্ট নয়৷ যদি ঢাকার কথা বলি, এখানে তো হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আছে৷ সারাদেশের কথা যদি বলি, তাহলে বলবো, আরো প্রয়োজন৷ শিশু বান্ধব হাসপাতাল আসলে অপ্রতুল৷
কিভাবে শিশুদের অধিকার সুরক্ষা করা যায়৷ এ ব্যাপারে সরকার ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আর কী করতে পারে?
সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা ইউনাইটেড নেশন চিলড্রেন রাইটস যে চার্টার সেখানে স্বাক্ষর করেছি৷ আমরা সেই আলোকেই কাজ করছি৷ আসলে সব সময় শিশু সেক্টরটা একটু অবহেলিত সেক্টর মনে হয়৷ আমাদের দেশে জনগণের যে বিশাল সংখ্যা, সেটাকে ম্যানেজ করতে গিয়ে আমরা শিশুদের বিষয়টা অতটা গুরুত্ব দেই না সবসময়৷ সবাই মিলে সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারলে এই জায়গাটাতে আমরা উন্নতি করতে পারব৷ বেসরকারী সংস্থাগুলো এককভাবে যে কাজটা করে সেটা যথেষ্ট নয়৷ সকল শিশুকে কাভার করতে গেলে বেসরকারী সংস্থার পাশাপাশি সরকারী প্রতিষ্ঠানের কাজকেও আরও বেগবান করতে হবে৷