জঙ্গিদের উপস্থিতি নিয়ে দ্বিমত নেই
১৮ নভেম্বর ২০১৫গত কিছু দিনের ঘটনাবলির প্রেক্ষাপটে এই বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে৷ সকলেই বোঝার চেষ্টা করছেন যে জঙ্গিবাদ ভবিষ্যতে কোন পথে এগোবে এবং দেশের রাজনীতি, নিরাপত্তা ও সমাজ জীবনের জন্য তা কতটা বিপদের ইঙ্গিত বহন করে৷ জঙ্গিবাদের ভবিষ্যৎ সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব না হলেও তার পথরেখা বিষয়ে ধারণা লাভ একেবারে অসম্ভব নয়৷ সেটা করার জন্যে আমাদের বিরাজমান পরিস্থিতির কয়েকটি দিক বিবেচনায় রাখতে হবে৷ যারা দেশে জঙ্গিবাদের ভবিষ্যৎ বিষয়ে চিন্তিত দু'টি বিষয়ে তাঁদের মনোযোগ আকর্ষণ করাই এই নিবন্ধের লক্ষ৷
প্রথমত এটি মোটেই বিস্ময়কর নয় যে, বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে জঙ্গিবাদের আবেদন তৈরি হচ্ছে৷ দেশের রাজনীতির ঐতিহ্যের মধ্যে যেহেতু সহিংস রাজনীতির একটি ধারা সব সময়ই বিরাজ করেছে সেহেতু এই আশঙ্কা থেকে বাংলাদেশ কখনোই মুক্ত ছিল না৷ এটা ঠিক যে অতীতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে চরমপন্থি রাজনীতি দীর্ঘ মেয়াদে গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা লাভ করেনি, তার অন্যতম কারণ হচ্ছে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাঁদের ক্ষোভ বিক্ষোভকে বিরাজমান কাঠামোর মধ্যেই প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছেন, ফলে গোটা কাঠামোটি ভেঙে ফেলার ব্যাপারে তাঁদের উৎসাহে ঘাটতি ছিল৷
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের সমাজে এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বড় ধরণের বদল ঘটেছে৷ দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই পরিবর্তন মোটেই ইতিবাচক নয়৷ আমরা দেখি যে সমাজে এবং মূলধারার রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতাই কেবল বিস্তার লাভ করেছে তা নয়, সহিংসতার ডিসকোর্স এখন স্বাভাবিক বলেই বিবেচিত হয়৷ সহিংসতার মাত্রা বেড়েছে ও প্রকৃতিতে পরিবর্তন ঘটেছে৷ বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিষয়ক আলোচনায় এই দিকগুলো কম আলোচিত হয় এই কারণে যে আমরা ধরে নেই যে, জঙ্গিবাদ মূলধারার রাজনীতি এবং সমাজে বিরাজমান সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত নয়৷ যখন তাকে যুক্ত বলে ভাবি তখন তাকে কোনো কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত করে বিবেচনা করতেই আমরা অভ্যস্ত৷ কিন্তু মূলধারার রাজনীতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবেই – তা অনুকূল বা প্রতিকূল যাই হোক – যে কোনো দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটে৷ যে কোনো সমাজে যখন এক গোষ্ঠী মানুষ সামাজিক বা রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্নতা বা প্রান্তিকতা অনুভব করেন; যখন মনে করেন যে, তাঁরা রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত তখন তাঁদের কাছে সহিংস উগ্রপন্থা বা জঙ্গিবাদ আবেদন সৃষ্টি করে৷ যখন তাঁরা মনে করে যে বিরাজমান সমাজ ও রাজনীতির কাঠামো তার জন্যে কিছুই দিতে পারছে না তখন তাঁরা রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক কাঠামো ভেঙে ফেলার বক্তব্য শুনতে আগ্রহী হয়৷ বাংলাদেশে গত কয়েক প্রায় এক দশকে এই ধারণাগুলো বিস্তার লাভ করতে শুরু করেছে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব এবং সর্বোপরি ২০১৪ সালের নির্বাচন, নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি, সংগঠিত বিরোধী দলের অনুপস্থিতি এবং নাগরিক অধিকারের ক্রমাগত অবসান এই ধারণার অনুকূলেই কাজ করছে যা জঙ্গিবাদের আবেদন বৃদ্ধির সহায়ক হয়ে উঠছে৷ সাথে সাথে এটাও স্মরণ করা দরকার যে, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে এই মানসিকতার মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে যা মনে করেন যে ইসলাম আক্রমণের বা বিপদের মুখোমুখি, ইসলামি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হুমকির মুখে৷
দ্বিতীয়ত কোনো দেশে জঙ্গি সংগঠনের আবেদন ও বিস্তারের কারণ কেবলমাত্র অভ্যন্তরীণ নয়৷ অভ্যন্তরীণ কারণগুলো ধাত্রীর ভূমিকা পালন করে বটে, তাঁর পেছনে থাকে বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ৷ বৈশ্বিক পরিস্থিতি বলতে আমি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের কথা বোঝাতে চাই৷ আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের মোকাবেলায় মার্কিনি অপরিনামদর্শী নীতি, মুজাহিদদের প্রতি নৈতিক এবং বৈষয়িক সমর্থন থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা দেশগুলোর দ্বিমুখী নীতি; ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেনের পরিস্থিতি; ফিলিস্তিনিদের অধিকারের প্রশ্ন সবই কোনো না কোনো ভাবে প্রভাব বিস্তার করে৷ শুধু তাই নয়, জঙ্গি সংগঠনগুলো নিজস্ব তাগিদে গড়ে উঠলেও তাঁদের অন্তর্জাতিক যোগাযোগ তৈরি হওয়ার জন্যে আনুষ্ঠানিকতার দরকার হয় না৷ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো যেমন এই ধরনের স্থানীয় জঙ্গিদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনে উৎসাহী থাকে, তেমনি স্থানীয় দুর্বল সংগঠনগুলোও চায় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্ত হতে৷ পারস্পরিক স্বার্থের বিবেচনায় এটি অত্যন্ত যৌক্তিক আচরণ৷
বাংলাদেশের গত কয়েক কিছু দিন যাবত প্রশ্ন উঠছে সেখানে আইসিস বা ভারতীয় মহাদেশে আল-কায়েদার (একিউআইএস) সাংগঠনিক উপস্থিতি আছে কিনা৷ এই আলোচনা থেকে মনে হতে পারে যে দেশে যে সমস্ত জঙ্গি সংগঠন উপস্থিত সেগুলো দেশের বাইরের যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন৷ এই ধারণা যে কত বিভ্রান্তিকর সেটা ইতিহাসের দিকে তাকালেই বোঝা যায়৷ বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠনের সূত্রপাত হয়েছে আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের হাতে এবং ১৯৯৬ সাল থেকেই পাকিস্তান ভিত্তিক হরকাতুল জেহাদ বাংলাদেশে উপস্থিত থেকেছে৷ পরে লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্যরা বাংলাদেশে উপস্থিত থেকেছে৷ ভারতের আদালতে বিচারাধীন সন্ত্রাসী বলে পরিচিত আবদুল করিম টুন্ডা দীর্ঘদিন বাংলাদেশে উপস্থিত থেকেই ভারতে তাঁর কার্যক্রম চালিয়েছে৷ ফলে এখানে আঞ্চলিক সন্ত্রাসীদের উপস্থিতির ঘটনা পুরনো৷ এখন আধুনিক প্রযুক্তির কারনে প্রত্যক্ষ উপস্থিতি যেখানে জরুরি নয় যেখানে আইসিস এবং একিউআইএস-এর সাংঠনিক উপস্থিতি বিষয়ে বিতর্ক নিরর্থক৷ গতকাল এই যোগাযোগ ছিল না তার অর্থ এই নয় যে, আজ সেই যোগাযোগ তৈরি হয়নি, তাঁদের কেউ ইতিমধ্যেই সেখানে মিশে নেই৷
ফলে ভবিষ্যৎ পথরেখা সম্পর্কে আঁচ – অনুমান, ধারণা লাভ কিংবা মোকাবেলার কৌশল তৈরি – যে বিবেচনায়ই আমরা জঙ্গিবাদ নিয়ে আলোচনা করিনা কেন, আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে যে এখন বৈশ্বিক পরিস্থিতি জঙ্গিবাদ বিস্তারের অনুকূলে৷ আইসিস-এর সাম্প্রতিক আচরণ, বিশেষত বৈরুত, আঙ্কারা, প্যারিসে হামলা প্রমাণ করে যে সংগঠনটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁদের প্রভাব ও উপস্থিত বিস্তারের চেষ্টা করছে, অন্যদিকে আল-কায়েদা সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লেও ভারতীয় উপমহাদেশে নতুন করে শক্তি সঞ্চয়ে আগ্রহী৷ ভারতে আইসিস-এর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের উপস্থিতির কথা ভারত সরকার স্বীকার করে, যদিও সরকারের দাবি সেই ব্যক্তিদের আটক করা হয়েছে৷ ফলে প্রশ্নটা এই নয় যে আইসিস আছে কি নেই, প্রশ্ন হচ্ছে এই ধরণের সংগঠনের আবেদন তৈরির অনুকূল পরিবেশ আছে কিনা এবং থাকলে তা অপসারণে কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে৷
আপনি কী অধ্যাপক আলী রীয়াজের সঙ্গে একমত? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷