ঝুঁকির মুখে এটিএম সেবা
২৭ জুলাই ২০১৩সর্বশেষ গত ২৪ জুলাই চার জনের একটি চক্রকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ৷ এই চারজনের সবাই মেধাবী ও শিক্ষিত৷ এর মধ্যে প্রধান ব্যক্তি মোহাম্মদ সেলিম৷ তিনি রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেছেন৷ দেশে বিদেশে তাঁর বেশ কয়েকটি ডিগ্রিও রয়েছে৷ ১৯৮৯, ৯০ ও ৯১ সালে ‘তরুণ উদ্ভাবক' হিসেবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে ১৪ লাখ টাকা পুরস্কারও পান তিনি৷ অনেকদিন ব্যাংকে চাকরি করেছেন৷ ১৯৯৮ সালে এটিএম সার্ভিস চালুর শুরুতে তিনি এই নেটওয়ার্কিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন৷
তাঁর সঙ্গে আরো গ্রেফতার হয়েছেন মঞ্জুরুল ইসলাম, আরিফ হোসেন খান ও আসাদুল ইসলাম৷ এর মধ্যে মঞ্জুরুল ইসলাম মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের আইটি বিভাগের কর্মকর্তা৷ আসাদুল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগ থেকে পাশ করেছেন৷ অপরজন আরিফ হোসেন খান খুলনা পালিটেকনিক থেকে পাশ করে অ্যাডভান্স ডাটা নেটওয়ার্ক (এডিএন) নামে একটি বেসরকারি কোম্পানির ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন৷ এই চারজনে কিছু ডাটা চুরি করে বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে দুই কোটি টাকারও বেশি তুলে নিয়েছেন৷ গ্রেফতারের পর তারা সেটা স্বীকারও করেছেন৷
এই কার্ড জালিয়াত চক্রকে গ্রেফতার করা গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার তৌহিদুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, এই চক্রের প্রত্যেক সদস্যই অত্যন্ত মেধাবী৷ তারা অল্প কিছু ডেটা পেলেই কার্ড তৈরি করতে পারে৷ পাসওয়ার্ড চুরি করা তাদের কাছে খুবই সহজ৷ অনেক সময় এটিএম বুথে গোপন ক্যামেরা সেট করে গ্রাহকদের পাসওয়ার্ড চুরি করে তারা৷ খুব অল্প দিনের মধ্যেই তারা দুই কোটি টাকারও বেশি বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে তুলে নিয়েছে৷ তাদের কাছ থেকে আরো ৫০টির মতো কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে৷ যা দিয়ে আরো প্রায় কোটি টাকা তোলা যেত৷ কিন্তু তার আগেই গোয়েন্দা পুলিশ সদস্যরা তাদের গ্রেফতার করতে পেরেছে৷
পুলিশের হাতে গ্রেফতারের পর মোহাম্মদ সেলিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, আরব বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ বাংলা, প্রাইম ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকের অন্তত ৯০০ বুথ তাঁর হাতে স্থাপন হয়েছে৷ যে কারণে এটিএম বুথের সবকিছু তাঁর নখদর্পণে৷ কিছু ডেটা পেলেই তিনি জাল কার্ড তৈরি করতে পারেন৷ কীভাবে তথ্য চুরি করে টাকা তুলেছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে সেলিম বলেন, বুথের সিপিইউ থেকে পেনড্রাইভে তিনি গ্রাহকের তথ্য চুরি করেন৷ পাসওয়ার্ড ও পিনকোড চুরি করতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরাও বসানো হয়৷ পরে কার্ড রিডার অ্যান্ড রাইটার যন্ত্রের মাধ্যমে ল্যাপটপের সহায়তায় সংগৃহীত তথ্য ব্যাংক কার্ডের ম্যাগনেটিক স্ট্রিপে ধারণ করে নতুন কার্ড তৈরি করতেন৷ ওই কার্ড ও গোপন ক্যামেরায় ধারণকৃত পাসওয়ার্ড দিয়ে টাকা উঠাতেন তিনি৷
গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মশিউর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথ সার্ভিসের আইটি সাপোর্ট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান টেক্সাস ইলেকট্রনিকস-এর প্রধান আইটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে সেলিম কর্মরত ছিলেন৷ অন্য তিন জনও সেলিমের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে আইটি এক্সপার্ট হিসেবে কাজ করেছেন৷ বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথের আইটি সাপোর্ট ও রক্ষণাবেক্ষণ করেছেন৷ পরবর্তীতে চাকরিচ্যুত হয়ে তারা নকল ক্রেডিট কার্ড তৈরি করে দুই কোটি টাকার ওপরে হাতিয়ে নিয়েছে৷
গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে নকল ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ড, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন গোপন ক্যামেরা, কম্পিউটার, কার্ড রিডার অ্যান্ড রাইটার (কার্ড তৈরির যন্ত্র) এবং অন্যান্য কম্পিউটার ও ইঞ্জিনিয়ারিং আইটেম পাওয়া গেছে৷ মশিউর রহমান বলেন, এই চক্রটিকে ধরার পর অনেকেই তাঁকে ফোন করে নিজের পকেটে থাকা ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চেয়েছেন৷ কেউ কেউ কার্ড ফেরত দেবেন বলেও তাকে জানিয়েছেন৷
এই চক্রটি বেশ কয়েকটি ব্যাংক থেকে টাকা তুলেছে৷ তবে বেশি টাকা তুলেছে ব্র্যাক ব্যাংক থেকে৷ তাই প্রশ্ন উঠেছে, ব্র্যাক ব্যাংকের এটিএম বুথ কি অরক্ষিত? ব্র্যাক ব্যাংকের আইটি বিভাগের প্রধান মো. কামরুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ব্র্যাক ব্যাংকের এটিএম বুথ কোনো ভাবেই দুর্বল নয়৷ কোনো ব্যাংকের ভেতর থেকে তথ্য চুরি করতে না পারলে বাইরে থেকে ভুয়া কার্ড বানিয়ে টাকা তোলা অনেক কঠিন৷ তাছাড়া বাংলাদেশে এটিএম সার্ভিস তো খুব বেশিদিন চালু হয়নি৷ তাই কিছু সমস্যা তো আছেই৷ কোনো সমস্যা ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে সমাধান করা হচ্ছে৷ এখন কিন্তু প্রত্যেক বুথে একাধিক সিসিটিভি লাগানো আছে৷ দায়িত্ব পালনকারী গার্ডদের সচেতন করা হয়েছে৷''
কামরুল হকের মতে, গ্রাহকরা সচেতন হলে প্রতারণার সুযোগ অনেক কমে যাবে৷ নিজের ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের পাসওয়ার্ড যেন কেউ জানতে না পারে, সে ব্যাপারে সবাইকে সচেতন থাকার পরামর্শ তার৷ এছাড়া এটিএম বুথে ঢুকে কোনো অসংলগ্নতা দেখলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকের অনলাইনে ফোন করে জানানোরও পরামর্শ দেন তিনি৷