যেতে হবে অনেক দূর...
১৫ ডিসেম্বর ২০১৫বাংলাদেশের নারীরা বিমান চালাচ্ছেন৷ যোগ দিচ্ছেন সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনীতেও৷ এমনকি ঝুঁকিপূর্ণ এবং কায়িক পরিশ্রমের পেশায়ও আসছেন তাঁরা৷ পেশাদার নারী বাসচালক বা ট্রেন চালক এখন পুরনো গল্প৷ এমনকি অটোরিকশা আর রিকশা চালতেও পিছিয়ে নেই নারী৷
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী ,দেশের ৫ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী৷ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ১৬ হাজার ৬৯৭ জন৷ বিদেশে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত ৭৬ লাখ প্রবাসীর মধ্যে ৮২ হাজার ৫৫৮ জন নারী৷ এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের ৮০ ভাগ কর্মীই নারী৷ দেশের ৯০ শতাংশ ক্ষদ্রঋণ ব্যবহারকারীও নারী৷
১৯৮৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে সরাসরি ভোটে মাত্র ৫ জন নারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন৷ বর্তমানে সংসদে ৬৯ জন নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন৷ মন্ত্রিসভায় নারী আছেন৷ প্রধানমন্ত্রী নারী৷ সাবেক প্রধানমন্ত্রীও নারী৷ নারী জাতীয় সংসদের স্পিকারও৷ সব মিলিয়ে দৃশ্যটা বেশ সুখকর বলেই আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়৷ তবে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি অন্তত চারটি মাপকাঠিতে বিবেচনা করা প্রয়োজন৷ আর সেই চারটি মাপকাঠিতে বাংলাদেশ কেমন অবস্থানে আছে, সেটাই এখন দেখার বিষয়৷
নারী উন্নয়নের মডেল অনুযায়ী নারীর ক্ষমতায়নের জন্য প্রথমত, ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নারীর মালিকানা স্থাপন৷ দ্বিতীয়ত, মানসম্মত কাজের পরিবেশ এবং মজুরি৷ তৃতীয়ত, শান্ত ও ন্যায় বিচার বা নায্যতা৷ এবং চতুর্থত, সবস্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর নের্তৃত্ব ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা৷
এই চারটি বিষয় নিয়ে যদি তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে বাংলাদেশে নারীরর ক্ষমতায়ন বিষয়টি স্পষ্ট হবে৷
ভূমি এবং প্রাকৃতি সম্পদের ওপর নারীর অগ্রাধিকার চিত্রটি জানা যায় এক গবেষণায়৷ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত চলতি বছরেই ‘‘নারীর ভূমি অধিকার ও বঞ্চনা'' শীর্ষক গবেষণায় বলেছেন, ‘‘মাত্র শতকরা চার ভাগ নারীর ভূমির উপর প্রকৃত মালিকানা রয়েছে৷ মুসলিম নারীরা উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির মালিকানা লাভ করলেও শতকরা মাত্র দুই থেকে পাঁচ ভাগ মুসলিম নারীর ভূমিতে প্রকৃত মালিকানা রয়েছে৷''
সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর অবস্থান কেমন? এর জবাব পাওয়া যাবে ঢাকার কয়েকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মুখে৷ তাঁদের কয়েকজন জানান, ‘‘নির্বাচিত হওয়ার তিন মাসের মধ্যে কোনো কাজই শুরু করতে পারিনি৷ কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের গুরুত্বই দেয়া হয় না৷'' গবেষণায় নারীর ক্ষমতায়নে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ৬ ধরনের বাধার কথা বলা হয়েছে৷
১. নারীর অংশগ্রহণ প্রক্রিয়ায় পরিবারের সমর্থনের অভাব এবং নিষেধ
২. নারী নের্তৃত্ব মেনে নেয়ার জন্য সামাজিক অনীহা
৩. পরিবারের পুরুষ সদস্যের ওপর নির্ভরতা বা নারীদের চলাচলের ওপর বাধা নিষেধ আরোপ
৪. অর্থনৈতিক সম্পদের অভাব
৫. শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব
৬. রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চার অভাব
এবার কর্মপরিবেশ এবং মজুরির কথা ধরা যাক৷ জাতীয় শ্রম শক্তি জরিপ প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে নারী শ্রমিকের সংখ্যা সাড়ে ৮ লাখ৷ তাঁরা সকলেই মজুরি বৈষম্যের শিকার৷ পুরুষের সমান কাজ করলেও তাঁরা মজুরি পান কম৷ উদাহরণস্বরূপ, গ্রামাঞ্চলে একই কাজ করে পুরুষ শ্রমিকরা গড়ে ১৮৪ টাকা পেলেও নারী শ্রমিকরা পান ১৭০ টাকা৷ ন্যায় বিচারের বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য এই একটি তথ্যই যথেষ্ঠ৷
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের শতকরা ৬০ ভাগের বেশি নারী তাদের পারিবারিক জীবনে কখনো না কখনো পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন৷
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভানেত্রী আয়েশা খানম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এট সত্য যে বাংলাদেশের শীর্ষ নীতি নির্ধারক নারী৷ গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নারী৷ নারীরা এখন শান্তি মিশনে আছেন, তাঁরা পাহাড়ে চড়েন, বিমান চালান, ক্রিকেট খেলেন৷ কিন্তু এটাই সত্যের পুরোটা নয়৷ ‘ব্ল্যাক স্পট'-ও আছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে যদি আসি তাহলে বলতে হবে যে, সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত নয়৷ নারী এখনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্ব পায় না৷ তাছাড়া নারীর প্রতি সহিংসতা বাংলাদেশে নারীর সব অর্জনকে ম্লান করে দেয়৷''
তিনি বলেন, ‘‘কর্মক্ষেত্রে নারী নিরাপদ নয়৷ পরিবেশ নারীবান্ধব নয়৷ তাই সত্যিকার অর্থে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য আরো অনেক দূর যেতে হবে৷''
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷