পাবলিক পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন
২০ জুন ২০১৬চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষায় রাজশাহী বোর্ডে বাংলা প্রথম পত্রের বহুনির্বাচনি অভীক্ষায় ‘ক' সেটের প্রশ্নে বলা আছে, ‘আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় প্রভু, আমার ক্ষুধার অন্ন তা বলে বন্ধ করনি তবু৷' অথচ প্রকৃতপক্ষে ‘প্রভু' শব্দের বদলে হবে ‘কভু' এবং ‘তবু' শব্দের বদলে হবে ‘প্রভু'৷
এইভাবে যশোর বোর্ডে গণিতের প্রশ্নে ছিল ১১টি ভুল৷ ঢাকা বোর্ডের পদার্থবিজ্ঞানের প্রশ্নেও ভুল পাওয়া গেছে পাঁচটি৷ এছাড়া রাজশাহী বোর্ডে বাংলা প্রথম পত্রে তিনটি এবং দ্বিতীয় পত্রে চারটি ভুল ছিল৷ ১১টি ভুল ধরা পড়েছিল চট্টগ্রাম বোর্ডের গণিতের প্রশ্নে, বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম মিলিয়ে৷
চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয় ১ ফেব্রুয়ারি আর শেষ হয় ৮ মার্চ৷ আর এরই মধ্যে পরীক্ষার ফলও প্রকাশ করা হয়েছে৷ জানা গেছে, বরিশাল বোর্ডে এসএসসি-তে ‘হিন্দু ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা' বিষয়ের উত্তরপত্র ভুলভাবে মূল্যায়নের কারণে ৮,৫০৯ জন পরীক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ পরে অবশ্য তাদের ফল পুনর্মূল্যায়ন করে দায়ীদের শাস্তি দেয়া হয়েছিল৷
একইভাবে পরীক্ষার সৃজনশীল প্রশ্নে ভুল থাকার কারণে ঢাকাস্থ নামি-দামি কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমাও চেয়েছে৷
সাধারণভাবে আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার জন্য মোট ৩২ সেট প্রশ্ন করা হয়৷ প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে এ সব প্রশ্ন থেকে লটারি করে প্রতি বোর্ডের জন্য চার সেট প্রশ্ন দেয়া হয়৷ কিন্তু তারপরও পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস একটি নিয়মিত ঘটনায় প্ররিণত হয়েছে বাংলাদেশে৷
প্রতিটি প্রশ্ন তৈরি ও পরিমার্জনে জড়িত থাকেন চারজন অভিজ্ঞ শিক্ষক, যাঁরা এ কাজের জন্য সম্মানী পান৷ যদিও এ সব শিক্ষক নির্বাচন করা নিয়ে স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে৷
বাংলাদেশে পাবলিক পরীক্ষাগুলো এখন নেয়া হয় সৃজনশীল পদ্ধতিতে৷ ২০১০ সাল থেকে এসএসসি এবং তারও আগে প্রাথমিকে পরীক্ষার ক্ষেত্রে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হয়৷ আর গত বছর থেকে এইচএসসি-তেও চালু হয়েছে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি৷ এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা, মানে মুখস্থ বিদ্যার পরিবর্তে চিন্তা এবং সৃষ্টিশীলতার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়৷ অবশ্য এ পদ্ধতি নিয়ে বিতর্কও কিছু কম নেই৷
সৃজনশীল পদ্ধতিতে পুরো বই পড়া থাকলে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় ভালো করার কথা৷ কারণ এখানে প্রশ্নে বইয়ের একটি ‘প্যারা' বা অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে তা থেকেই প্রশ্ন করা হয়৷ কিছু সমস্যা দিয়ে বলা হয় তার সমাধান করতে৷
এছাড়া বাংলাদেশে এখন অতীতের মতো আর প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ বা তৃতীয় বিভাগ নেই৷ ২০০১ সাল থেকে চালু হয়ছে ‘গ্রেডিং' পদ্ধতি৷ বর্তমানে ৮০ শতাংশ বা তদুর্ধ্ব নম্বর পেলে জিপিএ-৫, ৭০ থেকে ৭৯ শতাংশ নম্বর পেলে জিপিএ-৪, ৬০ থেকে ৬৯ শতাংশ নম্বর পেলে জিপিএ-৩.৫, ৫০ থেকে ৫৯ শতাংশ নম্বর পেলে জিপিএ-৩, ৪০ থেকে ৪৯ শতাংশ নম্বর পেলে জিপিএ-২ এবং ৩৩ থেকে ৩৯ শতাংশ নম্বর পেলে জিপিএ-১ প্রাপ্তির সনদ দেয়া হয়৷
এরপরেও সৃজনশীল পদ্ধতিতে এসএসসি পরীক্ষায় জিপি-৫ পাওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা হয়েছে৷ তাতে জিপিএ-৫ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থীই সাধারণ জ্ঞানের এমন সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনি, যা তাদের পারা উচিত ছিল বলে মনে করা হচ্ছে৷
তাই প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশের পরীক্ষা পদ্ধতি মেধা যাচাইয়ের জন্য সঠিক কিনা৷ অথবা এই সৃজনশীল পদ্ধতি মেধা যাচাইয়ে কি আদৌ কার্যকর?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা এবং গবেষণা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতির দু'টি দিক আছে৷ পরীক্ষা এবং মূল্যায়ন৷ কারা প্রশ্ন করছেন, কী প্রশ্ন করছেন এবং কারা মূল্যায়ন করছেন – সেই বিষয়গুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ এর সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কারা পড়াচ্ছেন, কীভাবে পড়াচ্ছেন – তাও বিবেচ্য৷''
তিনি বলেন, ‘‘ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে এই পদ্ধতির জন্য শিক্ষকরা উপযুক্ত নন৷ তাঁরা উপযুক্ত হলে শিক্ষার্থীদের উপকৃত হওয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু সেটা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না৷ এখানে মুখস্থবিদ্যা তেমন কাজে আসে না৷ আর গতানুগতিক প্রশ্নও নেই৷ তাই প্রশ্ন করাই একটি বড় যোগ্যতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷''
তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের গবেষণায় আমরা দেখেছি যে, সাধারণভাবে শিক্ষার্থীদের মান ভালো৷ কিন্তু তাদের সৃজনশীলের উপযোগী করতে পারছেন না শিক্ষকরা৷''
অধ্যাপক মজিবর রহমান বলেন, ‘‘প্রচলিত যে কোনো পরীক্ষা ব্যবস্থায় মেধা যাচাইয়ের সুযোগ নেই৷ আসলে আমরা পরীক্ষার্থী তৈরি করি, শিক্ষার্থী নয়৷ এই যেমন, কেউ ছবি আঁকায় ভালো, কেউ ভালো গণিতে৷ কেউ আবার কথা বলে ভালো বোঝাতে পারে, কেউ পারে লিখতে৷ অথচ সবার বিচার করা হচ্ছে একইভাবে৷ তাহলে মেধা যাচাই কীভাবে হবে!''
সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি আগে থেকে ধারণা করা প্রশ্নের ভিত্তিতে হয় না৷ এতে প্রশ্ন সাধারণ নিয়মের মধ্যে পড়েও না৷ কিন্তু তারপরও এর জন্য বাজারে গাইড বইয়ের ছড়াছড়ি৷ এমনকি এক্ষেত্রেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো ঘটনা ঘটে৷
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক রাশেদা কে চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে এ বিষয়ে বলেন, ‘‘সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ৷ আমাদের এখানে সেটাই হয়নি৷ না, প্রশিক্ষণ হয়েছে, কিন্তু কার্যকর প্রশিক্ষণ হয়নি৷ যদি হতো তাহলে বাজারে গাইড বই থাকত না৷ প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও তা কোনো কাজে দিত না৷''
তাই তাঁর বক্তব্য, ‘‘গাইড বই এখন শিক্ষকরাও ‘ফলো' করছেন৷ তাঁরা গাইড বই থেকেই প্রশ্ন করছেন৷ ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে৷ একটা ভালো পদ্ধতি উল্টো ফল দিচ্ছে৷''
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ইন্সটিটিউট ফর কারিকুলাম অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের (কেআইসিই) পরীক্ষা প্রধান কিম সাং-হুন পদত্যাগ করেন৷ তার পরপরই দেশটির শিক্ষামন্ত্রী হাওয়াং উ-ইয়াং জাতির কাছে ক্ষমা চান৷ কারণ, সেখানকার কলেজ স্কলাস্টিক অ্যাবিলিটি টেস্ট (সিএসএটি)-এ ইংরেজি ও জীববিজ্ঞান অংশের দু'টি প্রশ্নে ভুল ছিল৷ এ রকম দায় নিয়ে বাংলাদেশে কেউ পদত্যাগ বা ক্ষমা চেয়েছেন বলে এখনো শোনা যায়নি৷ অথচ আজও এ দেশে প্রশ্নপত্রে ভুলের ছড়াছড়ি৷ আর প্রশ্নপত্র ফাঁস? সে তো এক নিয়মিত ঘটনা...৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷