1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকটের নেপথ্যে কী?

১০ জুন ২০২৩

বাংলাদেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ১৬ হাজার থেকে ১৬ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট৷ আর এই চাহিদা হয় গ্রীষ্মকালে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ২৩ হাজার ৩৩৭ মেগাওয়াট৷ তারপরও বিদ্যুতের সংকট কেন?

https://p.dw.com/p/4SQLR
বিশ্লেষকরা বলছেন আমদানি নির্ভর জ্বালানির উপর ভিত্তি করে পাওয়ার প্লান্ট তৈরিই এই সংকটের মূল কারণ
বিশ্লেষকরা বলছেন আমদানি নির্ভর জ্বালানির উপর ভিত্তি করে পাওয়ার প্লান্ট তৈরিই এই সংকটের মূল কারণছবি: Mortuza Rashed/DW

বিশ্লেষকরা বলছেন আমদানি নির্ভর জ্বালানির উপর ভিত্তি করে পাওয়ার প্লান্ট তৈরিই এই সংকটের মূল কারণ৷

ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলার সংকটে পড়ায় জ্বালানি আমদানি করা যাচ্ছে না৷ আর বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়ার জন্যই এই আমদানি নির্ভর পরিকল্পনা করা হয়েছে হয়ে বলে দাবি করেছেন এক বিশ্লেষক৷

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, গত দুই দিন বৃষ্টি হওয়ায় লোডশেডিং কমেছে৷শুক্রবার দেশে লোডশেডিং ছিলো মাত্র ২৭৬ মেগাওয়াট৷ বিদ্যুতের চাহিদা ছিলো ১১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট৷ উৎপাদন হয়েছে ১১ হাজার ২৪ মেগাওয়াট৷ আর শনিবার ১২ হাজার ১৫০ মেগাাওয়াট চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ১১ হাজার ৭৯৮ মেগাওয়াট৷ ঘাটতি ৩৩৬ মেগাওয়াট৷ বৃষ্টির কারণে তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা বা ব্যবহার কমেছে৷

পিডিবি জানিয়েছে, গরমের সময়ে চাহিদা থাকে ১৬ হাজার  থেকে ১৬ হাজার ৬৫০ মেগাওয়াট৷ তখন গড়ে দুই থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট ঘাটতি থাকে৷ গত ৪ জুন দেশে লোডশেডিং ছিলো দুই হাজার ৫০০ মেগাওয়াট৷

বাংলাদেশে এখন ১৭০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে ৫৭টি পুরোপুরি উৎপাদনে আছে৷ পুরোপুরি বন্ধ আছে ৫১টি৷ আর আংশিক চালু বা বন্ধ আছে ৬২টি৷ এর কারণ বাংলাদেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি বেশিরভাগই আমদানি করতে হয়৷ আর ডলার সংকটের জন্য সেই আমদানি করা যাচ্ছে না৷ ভাড়াভিত্তিক যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র জ্বালানির অভাবে বসে আছে তাদেরও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে৷  বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত তাদের ১৮ হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়েছে৷

বাংলাদেশের মোট বিদ্যুতের উৎপাদন ৫১.০৫ ভাগ গ্যাসের উপর নির্ভরশীল৷ ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের উপর নির্ভর করে ৩৪ ভাগ, কয়লার ওপর নির্ভর করে ৭ দশমিক ৮৬ ভাগ৷ এছাড়া সৌর, পানি ও ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ আছে৷ ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল পুরোপরিই আমদানি নির্ভর৷ কয়লাও অনেকটাই আমদানি করা হয়৷  এলএনজিও বাইরে থেকে আনতে হয়৷ বাংলাদেশের গ্যাস উৎপাদন ক্ষমতা দুই হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট৷ কিন্তু সেটা উৎপাদন হচ্ছে না৷ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চাহিদা দুই হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট৷ কিন্তু সক্ষমতা অনুযায়ী গ্যাস উৎপাদন না হওয়ায় কেন্দ্রগুলো চাহিদামত গ্যাস পাচ্ছে না৷ দেশের বাইরে স্পট মার্কেট থেকে এখন এলএনজি কেনা হচ্ছে৷ কয়লার অভাবে কয়লা ভিত্তিক তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রই বন্ধ আছে৷ বিপিসি দাম শোধ করতে না পারায় তেল দিচ্ছে না কিছু সরবরাহকারী৷  বাংলাদেশের যে বিদ্যুৎ পরিকল্পনা তাতে ২০৩০ সাল নাগাদ এই খাতের শতকরা ৯০ ভাগ জ্বালানি আমদানি করতে হবে৷

'ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো শর্ট টার্মে ভালো ছিলো'

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের মুখপাত্র শামীম হাসান জানান, ‘‘বৃষ্টির কারণে এখন বিদ্যুতের চাহিদা কম৷ ১১-১২ হাজার মেগাওয়াটে নেমে এসেছে৷ তাই পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়েছে৷ কিন্তু যদি চাহিদা গরমের কারণে বেড়ে যায় তাহলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়৷''

তিনি জানান, ‘‘দেশের জ্বালানি তেল ভিত্তিক সব বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ আছে তেলের অভাবে৷ আমরা এই সংকটের সময় ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে অনুরোধ করেছিলাম অন্তত কিছু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য৷ আমরা জ্বালানি তেলের কিছু ব্যবস্থা করার কথাও বলেছিলাম৷ কিন্তু কাজ হয়নি৷ কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে শুধু রামপাল আংশিক চালু আছে৷ রামপালের জন্য আজ (শনিবার ) কয়লা এসেছে৷ পায়রা বন্ধ আছে৷ কয়লার জন্য এলসি খোলার প্রক্রিয়া চলছে৷ আমরা এখন প্রধানত নির্ভর করছি গ্যাস ভিত্তিকবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওপর৷ তাও আমাদের চাহিদার অর্ধেক পাচ্ছি৷ আমাদের দরকার এক হাজার ৫০০ এমএমসিএফডি৷ পাচ্ছি সর্বোচ্চ ৮০০ এমএমসিএফডি৷ ফলে উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেকের কিছু বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে৷''

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী শামসুল আলম বলেন, ‘‘বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানের পিছনে আসলে কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়ার উদ্দেশ্য কাজ করেছে৷ এটা আমরা শুরু থেকেই বলে এসেছি৷ একই সঙ্গে কিছু মানুষকে আমদানির ব্যবসার সুযোগ দিতে এটার জ্বালানি আমদানি নির্ভর করা হয়েছে৷ নিজস্ব জ্বালানির উপর নির্ভর না করে আমদানি নির্ভর হওয়ার পরিণতি আমরা এখন ভোগ করছি৷ এটা যে ভবিষ্যতে আরো কতো জটিল হতে পারে তা ভেবে আমি আতঙ্কিত৷ সৌরবিদ্যুতের জন্য আমরা যেসব প্যানেল, যন্ত্রপাতি এনেছি তাও কোনো কাজে আসছে না৷ আসলে বিদ্যুতের জন্য নয়৷ কাজ হয়েছে এখানে একটা বাজার বানিয়ে ব্যবসা করার জন্য৷''

তিনি বলেন, ‘‘আমরা গ্যাস ঠিক মতো অনুসন্ধান করিনি৷ আর এখনো যে গ্যাস আছে তা উত্তোলনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না৷ সেটা না করে আমরা তেল ভিত্তিক ভাড়ায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র করেছি৷ এখন বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ দিচ্ছি৷ এখন আমাদের ডলার ক্রাইসিস৷ এই সংকট কবে কাটবে জানি না৷'' চুক্তি অনুযায়ী রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ ডলারে দিতে হয়৷

'বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর মানে গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়া'

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সদস্য মকবুল ই ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘‘ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো শর্ট টার্মে ভালো ছিলো৷ কিন্তু তিন বছরের বেশি নয়৷ তিন বছরে তো তার বিনিয়োগ উঠে ব্যবসা হয়েছে৷তারপরও ১০-১২ বছর বসিয়ে বসিয়ে কেন ভাড়া দিতে হবে৷ এটা কোনো ওয়াইজ ডিসিশন নয়৷''

তার কথায়, ‘‘আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরতাই বিদ্যুতের এই বিপদ ঘটিয়েছে৷ কিন্তু আমাদের পর্যাপ্ত গ্যাস থাকার পরও আমরা তা উত্তোলন করছি না৷ তেল গ্যাস আহরণে উদ্যোগ নিচ্ছি না৷ কয়লার ব্যাপারে পরিবেশবাদীরা বাধা দিয়েছেন৷ তারপরও ওপেন না করে ক্লোজ পিট করা যেত৷''

তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘‘আমরা ৫০ মিলিয়ন রিজার্ভ নিয়ে বসে আছি৷ রশিদপুরে আমাদের গ্যাস আছে৷ সেটা নিয়েও বসে আছি৷ আসলে এখন আমাদের যে গ্যাসক্ষেত্রগুলো আছে সেখান থেকে অপটিমাম উৎপাদনের ব্যবস্থা করা উচিত৷''

এদিকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো নির্মাণের খরচও অন্য অনেক দেশের তুলনায় বেশি বলে জানান শামসুল আলম৷ তার দাবি, ‘‘এই অতিরিক্ত খরচের পিছনেও আছে গোষ্ঠী ও ব্যক্তি সুবিধা৷''