ব্লগার, বিদেশি হত্যা কেন হচ্ছে?
২ ডিসেম্বর ২০১৫বাংলাদেশে ব্লগার নামক একটা সম্প্রদায় যে শক্তিশালী হয়ে উঠছে সেটা জানা গিয়েছিল ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে, যখন একদল অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টের আহ্বানে ঢাকার রাজপথে নেমে আসে লাখো মানুষ৷ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে টানা কয়েকদিন সমবেত হয়েছিল দল, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ৷
নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে ইসলামপন্থিরা
রাজনৈতিক দলগুলো সেই বিশাল জনসমাবেশের সুযোগ নিতে চেয়েছে৷ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ সমাবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে৷ বামপন্থি দলগুলো আন্দোলনকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে রাখার চেষ্টা করেছে৷ রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে, বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার মাঝেই একটি দৈনিক পত্রিকা সুকৌশলে পুরো ব্লগার সম্প্রদায়ের কপালে ‘নাস্তিক' তকমা লাগিয়ে দিয়েছে৷
সেই তকমার পরিণতি বোঝা গেছে মুহূর্তের মধ্যেই৷ শাহবাগ খালি করে যখন আন্দোলনকারীরা বাড়ি ফিরছিল, তখনই ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে শোনা গেল ব্লগার রাজিব হায়দারকে হত্যার খবর৷ শাহবাগ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই ব্লগারকে হত্যার পর অনলাইনে প্রকাশ হতে থাকে তাঁর বিভিন্ন লেখা৷ অনেকে সেগুলোর মধ্যে ইসলামবিরোধী কথাবার্তা খুঁজে পেয়েছেন, কেউ কেউ সেসব লেখা রাজিবের নয় দাবি করেছেন৷ তবে দিনের শেষে ব্লগারদের সঙ্গে নাস্তিকতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, ইসলামপন্থিরা নেমে গেছে রাজপথে, নাস্তিক ব্লগারদের হত্যার দাবিতে৷
এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই ব্লগারদের মধ্যে নাস্তিক আছেন, যেমন আছেন ধর্মপ্রাণ মুসলমান, সেক্যুলার, অন্য ধর্মের বিশ্বাসীরা৷ তবে ২০১৩ সালের আগ অবধি তাদের উপস্থিতি নিয়ে কারো বিশেষ গাত্রদাহ ছিল না৷ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জানা গেল, ব্লগারদের নাস্তিক পরিচয় কতটা বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করেছে ধর্মীয় মৌলবাদীদের মনে৷
ব্লগার হত্যা, সরকারের সতর্ক প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশি-মার্কিন ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায় খুন হন ২৭ ফেব্রুয়ারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে৷ তাঁকে হত্যার মাধ্যমে উগ্রপন্থিরা বুঝিয়ে দেয় নাস্তিকতা তারা কোনোভাবেই সহ্য করবে না৷ এরপর খুন হন আরো তিন ব্লগার এবং প্রকাশক৷ সবাই অভিজিৎ রায়ের সঙ্গে বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন৷ তাঁর মুক্তমনা ব্লগ উগ্রপন্থিদের কাছে পরিচিত ‘নাস্তিকদের আখড়া' হিসেবে৷ তাই সুকৌশলে বেছে বেছে সেসব ব্লগার, প্রকাশকদের উপর হামলা হচ্ছে যারা নাস্তিকতা চর্চা করেন কিংবা সমর্থন করেন৷ নিজেদের আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পৃক্ত দাবি করা ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম' এ সব হত্যাকাণ্ডের দায় নিয়েছে৷
সরকার খুব সাবধানে, রাখঢাক বজায় রেখে সেসবের সমালোচনা করেছে৷ বোঝা যায়, উগ্র ইসলামপন্থিদের একটি শক্তিশালী অংশকে চটাতে চাচ্ছে না ক্ষমতাসীনরা৷ পাছে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয় তারা, সম্ভবত সেই ভয়ে৷
মাঠে হাজির ‘ইসলামিক স্টেট'
চলতি বছরের শেষভাবে এসে বিদেশি, ধর্মযাজক, পুলিশ এবং শিয়া মুসলমানদের উপর হামলা শুরু হয়েছে সুন্নি প্রধান মডারেট মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে৷ এক্ষেত্রে মাঠে হাজির আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী তথাকথিত ‘‘ইসলামিক স্টেট'' যারা ইতোমধ্যে গোটা বিশ্বে ত্রাস সৃষ্টি করেছে৷ মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক গোষ্ঠীটির অনলাইন প্রোপোগান্ডা ম্যাগাজিন ‘‘দাবিক'' বাংলাদেশ নিয়ে পাঁচ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যেখানে দেশটিতে সাম্প্রতিক হামলা থেকে শুরু করে ভবিষ্যত পরিকল্পনা, কারা তাদের বন্ধু, কারা শত্রু সবই উঠে এসেছে৷
প্রতিবেদনে জঙ্গি গোষ্ঠীটি জামায়াতে ইসলামীকে কতটা শত্রু মনে করে তা পরিষ্কারভাবে জানিয়েছে৷ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত নেতাদের ফাঁসিতে বরং সন্তুষ্ট তারা৷ নিষিদ্ধ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ' বা জেএমবি যারা কিনা গত দশকের মাঝামাঝি সময় বাংলাদেশে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল, তাদের দমন করায় সেসময় ক্ষমতায় থাকা বিএনপি, জামায়াতের উপর রুষ্ট ‘ইসলামিক স্টেট'৷ শুধু তাই নয়, জামায়াত গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে সমর্থন করে যা পুরোপুরি ইসলামবিরোধী মনে করে জঙ্গি গোষ্ঠীটি৷
কেউ কেউ বলতে পারেন, দাবিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনকে এত গুরুত্ব দেয়ার কী আছে? দাবিককে সূত্র ধরে বিশ্বের সব বড় বড় গণমাধ্যমই প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷ মিশরে রাশিয়ার যাত্রীবাহী বিমান বিধ্বস্তের পেছনে যে জঙ্গি গোষ্ঠীটির হাত আছে, তা বিস্তারিত জানা গেছে এই পত্রিকার মাধ্যমে৷ এরকম উদাহরণ অনেক৷ দাবিকই জানাচ্ছে, বাংলাদেশে আবারো সংঘবদ্ধ হয়েছে ইসলামিক স্টেট-এর মতাদর্শে বিশ্বাসী জঙ্গিরা৷ তারা স্থানীয় এক নেতার নেতৃত্বে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে ‘খেলাফত' প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে এখন৷ তাই সামনে আরো হামলা আসন্ন৷
এ সব হত্যাকাণ্ড কেন?
শুরুতেই লিখেছি, একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে আন্দোলনের মাধ্যমে ব্লগারদের শক্তি সম্পর্কে জানা গিয়েছিল৷ এরপর তাদের মধ্যে থাকা নাস্তিকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় ধর্মীয় মৌলবাদীরা, শুরু হয় বেছে বেছে ব্লগার হত্যা৷ কিন্তু এ সব হত্যার সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার কোন উদ্দেশ্য কী আছে? এই প্রশ্ন অনেকের মনে৷ কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আমার কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর জানা প্রয়োজন৷
১. নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে সবচেয়ে সোচ্চার ইসলামপন্থি গোষ্ঠী হেফাজতে ইসলাম৷ তারা গত দু'বছরে জামায়াতের ডাকা কোন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে কী অংশ নিয়েছে?
২. চলতি বছর বাংলাদেশে খুন হওয়া ব্লগার, প্রকাশক, বিদেশি, শিয়াদের মধ্যে কেউ কী সরাসরি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন?
৩. বিচার প্রক্রিয়া বানচাল যদি সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য হয় তাহলে বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্তদের উপর হামলা হচ্ছে না কেন?
৪. ইসলামিক স্টেট কেন কারণ ব্যাখ্যাসহ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক না থাকার কথা জানাচ্ছে?
চলতি বছর আলোচিত সবগুলো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জঙ্গিবাদের সম্পর্ক যতটা স্বচ্ছ, পরিষ্কার, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের সম্পর্ক ততটাই অস্বচ্ছ, অপরিষ্কার৷ শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন দলের নেতারা একটা সম্পর্ক টানার চেষ্টা করছেন৷ এ সব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে তারা দেদার গ্রেপ্তার করছেন বিএনপি, জামায়াতের নেতাকর্মীদের৷ তাতে হামলা কিন্তু থামছে না, বরং হামলার পরিধি বাড়ছে৷
প্রিয় পাঠক, ব্লগার, বিদেশি হত্যার উদ্দেশ্য কী হতে পারে? লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷