সুন্দরী প্রতিযোগিতা বনাম ট্যালেন্ট হান্ট
২৩ অক্টোবর ২০১৭কেউ হয়তো মনে করতে পারেন, এবারই বাংলাদেশে মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়েছে৷ কিন্তু তা ঠিক নয়৷ এবার নানা বিতর্কের কারণে এই প্রতিযোগিতা সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে৷ আর প্রথম বিতর্ক শুরু হয় বিচারকদের পক্ষপাতিত্ব নিয়ে৷ কয়েকজন বিচারক আবার দাবি করেন, তাঁরা যাকে সেরা সুন্দরী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন, তাঁর নাম ঘোষণা করা হয়নি৷ কিন্তু সর্বশেষ বিতর্ক ছিল জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলের মুকুট জেতার পর তাঁর ‘বিয়ের ঘটনা ফাঁস' হওয়া নিয়ে৷ আর সেই বিতর্কে তাঁর সেরা সুন্দরীর মুকুটটিই শেষ পর্যন্ত বাদ হয়ে যায়৷ আয়োজক কর্তৃপক্ষ নতুন করে জেসিয়া ইসলামকে ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ'-এর স্বীকৃতি দেন৷
এমনকি ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথম দিন মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ-এর নাম ঘোষণায়ও ভুল করা হয়েছিল৷ প্রতিযোগিতার শীর্ষ ১০ প্রতিযোগীর মধ্যে জান্নাতুল সুমাইয়া হিমিকে বিজয়ী ঘোষণা করার কিছুক্ষণের মধ্যেই আয়োজকরা জানান, তিনি হয়েছেন দ্বিতীয় রানারআপ৷ পরে জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়৷ পরে এভ্রিলও টিকতে পারেননি৷
১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম মিস বাংলাদেশ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়৷ ওই প্রতিযোগিতায় যিনি মিস বাংলাদেশ হন, তিনি মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার সুযোগ পান৷ কিন্তু ২০০৭ সালের পর এই প্রতিযোগিতা আর হয়নি৷ আর দীর্ঘ বিরতির পর এবার হলো মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ প্রতিাযোগিতা৷
১৯৯৪ সালে মিস বাংলাদেশ হয়েছিলেন অনিকা তাহের৷ তারপর ২০০৭ সাল পর্যন্ত মিস বাংলাদেশ হিসেবে যাঁদের নাম জানা যায়, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন: ইয়াসমিন বিলকিস সাথী,রেহনুমা দিলরুবা চিত্রা, শাইলা সিমি,তানিয়া রহমান তিন্নি, সোনিয়া গাজী, তাবাস্সুম ফেরদৌস শাওন, জান্নাতুল ফেরদৌস পিয়া৷ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সাল পর্যন্ত মিস বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা টানা হয়নি৷ মাঝখানে কয়েক বছর বন্ধ ছিল৷ আর ২০০৭-এর পর এবার আবার অনুষ্ঠিত হলো মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ৷ তবে এবারের প্রতিযোগিতার মতো আগেরগুলোর সঙ্গে মিস ওয়ার্ল্ড প্রযিাগিতার ফ্র্যাঞ্চাইজি ছিল না বলে একটি সূত্র দাবি করেছে৷
যতদূর জানা যায়, ৯০-এর দশকে বাংলাদেশে সুন্দরী প্রতিযোগিতা বা প্রথম আয়োজন করেন অধুনা বিলুপ্ত ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা'র প্রয়াত সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী৷ ওই একই গ্রুপের আরেকটি বিনোদন পত্রিকা ‘আনন্দ বিচিত্রা'র ব্যানারে তখন আয়োজন করা হয়েছিল ‘আনন্দ বিচিত্রা ফটো সুন্দরী'৷ এরপর ১৯৯৫ সালে ওই প্রতিযোগিতার নাম হয় ‘লাক্স-আনন্দ বিচিত্রা ফটো সুন্দরী'৷ ওই প্রতিযোগিতায় শুধু মাত্র ছবির ওপর ভিত্তি করে ফটোসুন্দরী নির্বাচন করা হতো৷ র্যাম্পে হাঁটা বা প্রশ্নের জবাব দেয়ার কোনো বিষয় ছিল না৷ চিত্র নায়িকা মৌসুমী ওই প্রতিযোগিতা থেকেই গ্ল্যামার জগতে উঠে আসেন৷
শাহাদত চৌধুরী মারা যান ২০০৫ সালে৷ তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন সাংবাদিক এবং ফেমিনিস্ট রাইটার জব্বার হোসেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শাহাদত চৌধুরী ফটো সুন্দরী প্রতিযোগিতা শুরু করেছিলেন ১৯৮৭ সালে৷ এটা চলে ২০০৫ সাল পর্যন্ত৷ আর ওই বছরই তিনি প্রয়াত হন৷ এটার বৈশিষ্ট্য ছিল যে, ছবি আহ্বান করা হতো আর এই ছবির ওপর ভিত্তি করেই বিচার করা হতো৷ তবে নির্বাচনের পর যখন শো হতো, তখন প্রতিযোগীরা সামনে আসতেন৷''
তারপর আলোচনায় আসে লাক্স-চ্যানেল আই সুপার স্টার- প্রতিযোগিতা৷ আর এই প্রতিযোগিতার সেরারা ‘লাক্স সুন্দরী' নামে পরিচিতি পেতে থাকেন৷ ২০০৫ সালে এই প্রতিযোগিতা শুরু হয়৷ আর প্রথম লাক্স সুন্দরী হন শানারৈ দেবী শানু৷ তারপর যাঁরা লাক্স সুন্দরী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন: জাকিয়া বারী মম, বিদ্যা সিনহা সাহা মীম, ইসরাত জাহান চৈতি, মেহজাবিন চৌধুরী, মাহবুবা ইসলাম রাখি, সামিয়া সাঈদ, নাদিয়া আফরিন৷ এই প্রতিযোগিতাটি আর্থিক পুরস্কার, বিজ্ঞাপনচিত্রে অভিনয়ের সুযোগসহ নানা কারণে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়৷
লাক্স সুন্দরী বলা হলেও এই প্রতিযোগিতায় সুপারস্টার পান ‘বাংলাদেশ ফেস অফ লাক্স' খেতাব৷ সঙ্গে একটি ব্র্যান্ড নিউ গড়ি, ১০ লাখ টাকা এবং অভিনয়ের সুযোগ৷ প্রথম রানার-আপ পান ৫ লাখ টাকা এবং দ্বিতীয় রানার-আপ পান ৩ লাখ টাকা৷ চ্যানেল আই এবং ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের পক্ষ থেকে এই পুরস্কার দেয়া হয়৷
ভিট-চ্যানেল আই টপ মডেল, এটিএন-এর ‘সুপার হিরো সুপার হিরোইন' আর মিস ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-এর মধ্যে সুপার হিরো সুপার হিরোইন প্রথম বছরের পরই বন্ধ হয়ে যায়৷ একুশে টিভি'র ‘মিস ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ' প্রাথমিক কাজ শুরু করলেও পরে আর আলোর মুখ দেখেনি৷
এছাড়া এ বছর থেকে বিউটি কনটেস্ট ‘কুইন অব সাউথ এশিয়া'র সঙ্গে যুক্ত হয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলা৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসীরা মিস বাংলাদেশ প্রতিযোগিতার আয়েজন করেন অনিয়মিতভাবে৷ সেসব প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ থেকে গিয়ে অংশ নেন অনেকে৷ এছাড়া বাংলাদেশি নারীর বিদেশি খেতাব অর্জনেরও রেকর্ড আছে৷
২০১৪ সালে ‘মিস আয়ারল্যান্ড হয়েছেন বাংলাদেশের মেয়ে মাকসুদা প্রিয়তি৷ ৭০০ প্রতিযোগীকে হারিয়ে ‘মিস আয়ারল্যান্ড' নির্বাচিত হন৷ একই সঙ্গে তিনি পেয়েছেন ‘সুপার মডেল' ও ‘মিস ফটোজেনিক' খেতাব৷
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত লাক্স-চ্যানেল আই সুপার স্টার- প্রতিযোগিতাই সবচেয়ে আলোচিত৷ এই প্রতিযোগিতার আয়োজক প্রতিষ্ঠান চ্যানেল আই-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর এটাকে অবশ্য ‘বিউটি কন্টেস্ট' বা সুন্দরী প্রতিযোগিতা বলতে নারাজ৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা ট্যাল্টেন্ট হান্ট৷ আমরা প্রতিযোগীর মেধা এবং যোগ্যতাকে বিবেচনায় নিই৷ সুন্দরী প্রতিযোগিতা আলাদা বিষয়৷ ওই ধরনের প্রতিযোগিতার সঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতার কোনো মিল নাই৷''
তিনি বলেন, ‘‘আপনারা যদি লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখবেন, লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টারই টেলিভিশন নাটক, সিনেমা, মঞ্চ এবং মডেলিংয়ে দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন৷ তাঁরা তাঁদের প্রতিভার সাক্ষর রাখছেন৷ অনেকেই বলে থাকেন, লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতা না থাকলে হয়তো এইসব প্রতিভা বেরিয়ে আসতো না৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘এই প্রতিযোগিতায় যাঁরা আসেন, তাঁদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়৷ তারপর যাঁরা সেরা হন, তাঁদের দিকেও সব সময় খেয়াল রাখে আমাদের একটি টিম৷ তাঁরা পেশাগতভাবে কী করছেন, তাদের কোনো সহযোগিতা প্রয়োজন হয় কিনা, তা আমরা দেখি৷ ইমপ্রেস যেসব প্রোডাকশন করে, সেখানে আমরা সব সময় এই সেরাদের নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করি৷''
লাক্স- চ্যানেল আই সুপার স্টার-কে সুন্দরী প্রতিযোগিতা না বলে ট্যালেন্ট হান্ট কেন বলছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এটা তো ট্যালেন্ট হান্টই৷ আমরা তো অভিনয় প্রতিভা খুঁজে বের করি৷ প্রতিভার খোঁজ করি৷ সুন্দরী প্রতিযোগিতা আলাদা জিনিস৷ তার সঙ্গে এর কোনো মিলই নাই৷''
শানারৈ দেবী শানু ২০০৫ সালে লাক্স- চ্যানেল আই সুপার স্টার-এর প্রথম বিজয়ী৷ তিনি অভিনয় জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন৷ একজন নৃত্যশিল্পী৷ কবি হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছেন সম্প্রতি৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার পর আমি ফোকাসড হয়েছি৷ আমার যে প্রতিভা ছিল, তা কাজে লাগাতে এই অর্জন আমাকে অনেক সহায়তা করেছে৷ আমি আমার বিকাশের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম পেয়েছি৷ প্রথম এক বছর আমি লাক্স ও চ্যানেল আই-এর সঙ্গে তাদের নাটক ও বিজ্ঞাপনের জন্য চুক্তিবদ্ধ ছিলাম৷ আমার ক্যারিয়ার গড়তে তাঁরা সহায়তা করেছেন৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমি নিজেও এটাকে সুন্দরী প্রতিযোগিতা মনে করে অংশ নেইনি৷ আমার কাছে ট্যালেন্ট হান্টই মনে হয়েছে৷ তবে আমাদের একটা ট্যাগ ছিল প্রতিযোগিতার- সুন্দরী তোমার গুণের খোঁজে৷ তাই এটা হয়তো সুন্দরীদের গুণ খোঁজার প্রতিযোগিতা৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এখন যে সুন্দরী প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, সেটা আরো অর্গানাইজড হওয়া প্রয়োজন৷ কারণ, মিস বাংলাদেশ বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন৷ এবার যে বিতর্ক হয়েছে, যদি সঠিকভাবে বিচার এবং যাচাই করা হতো, তাহলে হয়তো এই বিতর্ক হতো না৷''
এই প্রতিযোগিতায় শুধু সেরা নয়, প্রথম ১০ জনের মধ্যে যাঁরা থাকেন তাঁদের প্রায় সবাই প্রতিষ্ঠার পথ খুঁজে পান বা প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পান৷ জাকিয়া বারি মম, বিদ্যা সিনহা মিমসহ আরো অনেকেই এখন বাংলাদেশের অভিনয় ও মডেলিং-এ বড় জায়গা করে নিয়েছেন৷
এবারের ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ' নিয়ে যে বিতর্ক হয়েছে তা নিয়ে কথা বলতে আয়োজক প্রতিষ্ঠান অন্তর শোবিজ-এর প্রধান স্বপন চৌধুরীর সঙ্গে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি৷এই প্রতিবেদন তৈরির সময় মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ জেসিয়া ইসলাম চীনে অবস্থান করছিলেন মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে৷ আর খেতাব হারানো জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলও কথা বলতে রাজি হননি৷
তবে ওই প্রতিযোগিতার বিচারক শম্পা রেজার সঙ্গে কথা হয়৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এবারের আয়োজনে মিসম্যানেজমেন্ট ছিল৷ যা-ই হোক হয়ে গেছে, আমি আর বেশি কিছু বলতে চাই না৷ তবে এ ধরনের আয়োজন যাঁরা করবেন, তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা আরো বেশি থাকতে হয়৷''
তিনি বলেন, ‘‘এ ধরনের প্রতিযোগিতা আমাদের নারীদের আরো আনেক কিছু শেখার সুযোগ করে দেয়৷ তাঁরা দেশের বাইরে যাবেন, অনেক কিছু দেখবেন এবং শিখবেন৷ আমি এটাকে শেখার একটা মাধ্যম হিসেবেই দেখি৷''
বিচার ও বিচারকদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘যাঁরা পুরো সময় বিচারের দায়িত্বে থাকবেন, তাঁদের অনেক অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, বুঝতে হবে৷ আর বিচারের ক্ষেত্রে ইন্টারন্যাল লুক, মেধা, বুদ্ধি এগুলোকেই বিবচনায় নিতে হয়৷''
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷