বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ‘উচ্চ ঝুঁকি’ দেখছে ডাব্লিউইএফ
১৩ জানুয়ারি ২০২৩আরো যে চারটি ঝুঁকি রয়েছে, তা হলো, ঋণসংকট, উচ্চ পণ্যমূল্যের ধাক্কা, মানবসৃষ্ট পরিবেশগত ক্ষতি ও সম্পদের জন্য ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা৷
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০২২ সালের প্রথম ভাগের প্রেক্ষাপটে এই জরিপ৷ কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি তাতে রিজার্ভ ও ডলার সংকটই বাংলাদেশের অর্থনীতির এক নাম্বার ঝুঁকি৷ এখন জরিপ হলে এটাই হবে শীর্ষ ঝুঁকি৷
ডাব্লিউইএফ-এর ধারণাগত এই জরিপে মোট ৩৫টি ঝুঁকির কথা বলা হয়৷ জরিপে অংশগ্রহণকারীদের শীর্ষ পাঁচটি ঝুঁকি চিহ্নিত করতে বলা হলে তারা ক্রমানুসারে ওই পাাঁচটি ঝুঁকি চিহ্নিত করেন৷ জরিপে অংশগ্রহণকারীরা হলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান৷ বাংলাদেশের মোট ৭২টি কোম্পানি জরিপে অংশ নেয়৷
অন্যান্য দেশেও তারা এই জরিপ করেছে৷ তাদেরও শীর্ষ পাঁচটি ঝুঁকি চিহ্নিত করতে বলা হয়৷ সার্বিক জরিপ থেকে তারা সারা বিশ্বে আগামী দুই বছরের অর্থনৈতিক ঝুঁকি চিহ্নিত করেছে৷ জরিপের ফলাফল থেকে তারা বলছে, বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে৷
বাংলাদেশে ডাব্লিউইএফ-এর অংশীদার হিসেবে কাজ করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)৷
পরিস্থিতির ব্যাখ্যা
২০২১ সালের নভেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর থেকে মূল্যস্ফীতি মাত্রা ছাড়িয়েছে৷ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব বলছে, ২০২২ সালের আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯.৮৬ শতাংশ৷ পরের মাসে, অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে কিছুটা কমে ৯.১ শতাংশ হয়৷ ওই দুই মাসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল৷ খাদ্য মূল্যস্ফীতির বড় কারণ ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি৷ সেই সঙ্গে আছে জ্বালানির উচ্চ মূল্য৷
চলতি বছরের শেষে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে৷ আর ২০২৪ সাল শেষে বিদেশি ঋণের পরিমাণ হবে ১৩০ বিলিয়ন ডলার৷ বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ২০২১ সালে সুদসহ দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ১১.৭ বিলিয়ন ডলার৷ ২২ সালে আগের বছরের তুলনায় বাংলাদেশকে দ্বিগুণ বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে৷ এর পরিমাণ ২৩.৪ বিলিয়ন ডলার৷
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ খাদ্য, জ্বালানি তেল ও বিশ্ব রাজনীতিতে নানা সংকটের মুখে পড়ছে৷
লার ও রিজার্ভ সংকটই শীর্ষে
সিপিডির গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানান, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে বাংলাদেশসহ বিশ্বের আরো ১৪০ দেশে একই প্রশ্নপত্রে এই জরিপ করা হয়৷ তিনি বলেন, ‘‘এখন যা পরিস্থিতি তাতে সহসা উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমবে না৷ ডলার সংকট, খাদ্যপণ্যের বিশ্বব্যাপী উচ্চমূল্য ও সংরক্ষণবাদী মনোভাব এখন চলমান৷ বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরাও সব কিছু বিবেচনা করে আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন৷ চলতি বছরের প্রথমার্ধে এরকমই চলবে৷ দ্বিতীয়ার্ধে যদি ইউক্রেন যুদ্ধ থেমে যায়, জ্বালানি তেল ও ডলারের সংকট কমে যায়, তবে বিছুটা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে৷ একটাই স্বস্তিদায়ক বিষয় হলো আমাদের অভ্যন্তরীণ কৃষি এই সময়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে৷’’
তার কথা, ‘‘প্রতি মাসে এখন রিজার্ভের এক বিলিয়নের বেশি ডলার কমে যাচ্ছে৷ এইভাবে রিজার্ভ সংকুচিত হতে থাকলে ২০-২৪ মাসে আমাদের রিজার্ভ তলানিতে চলে যাবে৷ তাই ডলার ও রিজার্ভ সংকট অনেক বড় আকারে দেখা দিচ্ছে৷ জরিপটি করা হয় গত বছরের প্রথম দিকে৷ যদি এই বছর করা হতো, তাহলে হয়ত এই সংকটটিই এক নাম্বার সংকট হিসবে আসতো৷ এই ডলার সংকট পিছিয়ে দিতে আমাদের বিদেশি ঋণ প্রয়োজন৷ সেটার ব্যবস্থা করতে হবে৷ এখানো বৈদেশি ঋণ-পরিস্থিতি ভালো আছে৷ আরো ঋণ নিয়ে তার ব্যবস্থাপনা ভালো করলে সংকট কাটাতে সহায়তা করবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের ওপর ভূ-রাজনৈতিক চাপ বাড়ছে৷ খাদ্য, জ্বালানি তেল নিয়ে বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণ হচ্ছে৷ তেমনি ইউক্রেন ইস্যুতে রাজনৈতিক অবস্থানের চাপও বাড়ছে৷ বাংলাদেশ এখনো মধ্যবর্তী অবস্থানে আছে৷’’
সংকট মোকাবেলার পরিকল্পনা
পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক, অর্থনীতিবিদ ড.আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব অর্থনীতিই ঝুঁকির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে৷ ঝুঁকি থাকবে, কিন্তু ঝুঁকি মোকাবেলার পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নই আসল কথা৷ ভারত যত সক্ষমতার সঙ্গে এটা করছে, আমরা তা পারছি না৷ আমরা চেষ্টাও করিনি৷ মূল্যস্ফীতি, ডলার ক্রাইসিস- এগুলোর জন্য ব্যাংকরেট বাড়ানো দরকার ছিল৷ মূদ্রানীতিকে আমরা ব্যবহার করিনি৷’’
তিনি মনে করেন, ‘‘ঋণ সংকটটা মধ্য মেয়াদী৷ তবে ঋণ নিয়ে তা ঠিকমতো ব্যবহার করলে সংকট হওয়ার কথা নয়৷ কিন্তু এখনো অনেক প্রকল্প নেয়া হচ্ছে, যা এখন নেয়া ঠিক না৷ হওড়ে এত টাকা খরচ করে উড়াল সেতু এখন আমাদের জন্য উচ্চাভিলাষী৷ আর ক্লাইমেট নিয়ে কথা হয়, কিন্তু কাজ হয় না৷’’
‘‘তবে যেটা ওরা (ডাব্লিউইএফ) যেটা বলেনি, সেটা হলো, ডলার সংকট, ব্যাংকে তারল্য সংকট, রিজার্ভের সংকট৷ ওরা গত বছরের যে সময়ে জরিপ করে, তখন এই সংকট সামনে আসেনি৷ এখন জরিপ করলে এই সংকট এক নাম্বারে চলে আসতো,’’ অভিমত এই অর্থনীতিবিদের৷