1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ভারতের নির্বাচনের মোদীময় কাভারেজ

১০ মে ২০২৪

জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলোর সজাগ দৃষ্টি থাকবে – এটাই স্বাভাবিক৷ কারণ, সংবাদ বিবেচ্য উপাদানের দিক থেকে নৈকট্যকে অগ্রাহ্য করার সাধ্য কোনো গণমাধ্যমেরই নেই৷

https://p.dw.com/p/4fi5h
জম্মুতে লোকসভা নির্বাচনে ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন ভোটাররা
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফল নিয়ে আগ্রহ রয়েছে প্রতিবেশি বাংলাদেশের জনগণ এবং গণমাধ্যমেরওছবি: Channi Anand/AP Photo/picture alliance

তবে কোনো কোনো দেশের জাতীয় নির্বাচন সে দেশের অভ্যন্তরীণ সীমানা ছাড়িয়ে বাইরের দেশগুলোর গণমাধ্যমেও ঝড় তুলতে আমরা দেখি৷

বিশেষ করে বিশ্ব রাজনীতি, জনসংখ্যা বা ভোটারের কলেবর ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার বিচারে বৃহৎ শক্তির দেশগুলোর জাতীয় নির্বাচন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নেয়৷ যেমন – যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো দেশগুলোর জাতীয় নির্বাচনের খবর বিশ্বের সব দেশের গণমাধ্যমে কমবেশি স্থান করে নেয়৷ বাংলাদেশের গণমাধ্যমেও ভারতের লোকসভা নির্বাচন নিয়ে খবরের পাশাপাশি মতামত প্রকাশিত হচ্ছে৷ তবে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে দু'দেশের সম্পর্ক এবং দেশ দুটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পরস্পরের গুরুত্বের নিরিখে এই প্রকাশমান কাভারেজ কতটুকু স্বচ্ছ কিংবা নির্ভুলতা, ভারসাম্য ও স্পষ্টতার নিরিখে মানোত্তীর্ণ সেটি নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে৷ কারণ, যে কোনো নির্বাচনি কাভারেজ নির্বস্তুক কোনো সত্তা নয়৷ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক এজেন্ডা, গণমাধ্যমের নিজস্ব নীতি এবং পাবলিক এজেন্ডা নির্বাচনের সময় মিলেমিশে একাকার হতে দেখা যায়৷ এটি গণমাধ্যমের কাভারেজের ক্ষেত্রে এক ধরনের শংকর বা হাইব্রিড উপস্থাপনা আমাদের সামনে তুলে ধরে৷ এই ধরনের শংকর উপস্থাপনা শুধু পাঠকদের বিভ্রান্ত করে না, অনেক ক্ষেত্রে ভুল এবং অপতথ্যও ছড়ায়৷ 

ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ৷ প্রায় ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশটির লোকসভা নির্বাচনে তৃতীয় দফা ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে৷ এ নিয়ে সারা ভারতের ৫৪৩টি আসনের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি আসনে ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে৷ জনসংখ্যা আর ভোটারের কলেবর বিবেচনায় ভারতের এই নির্বাচনটি বিশ্বের বৃহৎ গণতন্ত্রযজ্ঞ হিসেবে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে স্বীকৃত৷ প্রায় ছয় সপ্তাহজুড়েঅনুষ্ঠেয় এ নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা প্রায় ৯৬ কোটি ৮০ লাখ৷ এই বিশাল ভোটার সংখ্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, ফ্রান্সের জনসংখ্যার প্রায় সমান৷ অর্থাৎ, এই দেশগুলোর জনসংখ্যার সমান সংখ্যক ভোটার ভারতের ১৫ লাখ কেন্দ্রে ভোট দেবেন৷ গণতন্ত্রের এই বৃহৎযজ্ঞের গুরুত্ব স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলোর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সংবাদ৷ আর বাংলাদেশের গণমাধ্যমের কাছে ভারতের লোকসভা নির্বাচনের অর্থবহতা আরো বেশি৷ কারণ, ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের সম্পর্কের যত চড়াই-উৎরাই ঘটেছে, ততই দু'দেশের রাজনীতি ও কূটনৈতিক সম্পর্কে নিজেদের অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলো সীমানা ছাড়িয়ে বরাবর অন্য দেশ ও দেশের মানুষকে প্রভাবিত করেছে৷ উপরন্তু হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ও বিরোধ এবং সাম্প্রদায়িকতা ইস্যু দুটি দেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত শক্তিশালী প্রভাব বিস্তারকারী নিয়ামক হওয়ায় দেশ দু'টির সাধারণ জনগণের মাঝে অন্য দেশের রাজনৈতিক গতিপথ, নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ বেশিই থাকে৷ তাছাড়া আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্যও ভারত ও বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি অন্য দেশের জন্য চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়৷

যে কোনো দেশের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে চারটি পক্ষ জড়িত থাকে – প্রার্থী ও রাজনৈতিক দল, ভোটার, নির্বাচন পরিচালনা প্রশাসন এবং গণমাধ্যম৷ জাতীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন সাধারণত একটি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক যজ্ঞ বিবেচিত হয়৷ তাই নির্বাচন এলেই গণমাধ্যমের ব্যস্ততা বেড়ে যায়৷ এ সময়ে পাঠক-দর্শকের মধ্যে তথ্যের জন্য অন্যান্য সময়ের চেয়ে সংবাদমাধ্যমের ওপর নির্ভরতা বাড়তে দেখা যায়৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রসারতার কারণে তথ্যের উৎস হিসেবে প্রথাগত সংবাদমাধ্যমের ওপর মানুষের নির্ভরতা কমার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে৷ তা সত্ত্বেও তথ্যের, বিশেষ করে রাজনৈতিক তথ্যের বিশ্বাসযোগ্য উৎস হিসেবে এখনও পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে প্রথাগত সংবাদমাধ্যমের ওপর মানুষের চোখ থাকে বেশি৷ এটি শুধু স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে নয়, প্রতিবেশী ও নিজ দেশের বাইরের দেশগুলোর নির্বাচনের খবর জানার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য৷ সামাজিক মাধ্যমের যতই প্রসার ঘটুক না কেন বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনও ভারতীয় নির্বাচনের খবর জানতে নিজ দেশের বাংলা ভাষার সংবাদমাধ্যমের ধারস্থ হয় বেশি৷ সবশেষ জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের মানুষের কাছে খবর ও তথ্যের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম টেলিভিশন হলেও সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যম সংবাদপত্র৷ দেশ ও দেশের বাইরের রাজনৈতিক এবং স্পর্শকাতর ইস্যুগুলো সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের জন্য বাংলাদেশের মানুষ এখনও সনাতন বা মূলধারার সংবাদপত্রের ওপরই বেশি আস্থাশীল৷ এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোতে ভারতের চলমান লোকসভা নির্বাচন নিয়ে প্রকাশিত সংবাদ ও মতামতধর্মী লেখাগুলো এই নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশবাসীর ধারণা গঠনে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে বলেই স্বাভাবিকভাবে ধরে নেয়া যায়৷

ভারতের লোকসভা নির্বাচন ১৯ এপ্রিল থেকে শুরু হলেও বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় এ সংক্রান্ত নির্বাচন চলতি বছরের শুরু থেকে প্রকাশিত হতে দেখা যায়৷ বিশেষ করে নাগরিকত্ব আইন, কংগ্রেসসহ প্রধান বিরোধী দলগুলোর জোট গঠন এবং কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারের পর থেকে এ সংক্রান্ত খবর ও বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধ প্রকাশের প্রবণতা বাড়তে থাকে৷ ভারতের লোকসভা নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকার গত চার মাসের আধেয় বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যাবে৷ প্রথম বৈশিষ্ট্যটি হলো, বিজেপির তুলনায় কংগ্রেসসহ অন্যান্য বিরোধী দলের কাভারেজ কম৷ আরো সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, নরেন্দ্র মোদি এই নির্বাচনে বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোতে যতটা কাভারেজ পাচ্ছেন সে তুলনায় বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা অনেক কম আলোচিত৷ এ অভিযোগটি বেশ কিছুদিন আগে ভারতীয় গণমাধ্যম সম্পর্কে কংগ্রেসের মুখপাত্র সুপ্রিয়া করেছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, ভারতীয় মূলধারার গণমাধ্যম যখন কংগ্রেসকে একেবারে ব্ল্যাকআউট করে দিয়েছে তখন সামাজিক মাধ্যমের সহায়তায় তার দল জনগণের কাছে পৌঁছেছে৷

ভারতের লোকসভা নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমের খবর ও মতামতধর্মী প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করলে একটি সাধারণ সমীকরণ খুব সহজেই টানা যায়৷ সেটি হলো নির্বাচনে ইস্যুভিত্তিক সংবাদের চেয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংবাদ বেশি প্রকাশিত হচ্ছে৷ ভারতীয় নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কাভারেজের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাবো সেখানে ইস্যুভিত্তিক সংবাদ প্রকাশের প্রবণতা বেশি৷ উদাহরণস্বরূপ, নির্বাচনি বন্ড নিয়ে বিতর্ক ভারতের এই লোকসভা নির্বাচনে একটি অন্যতম প্রধান আলোচিত ইস্যু৷ কিন্তু বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো এ নিয়ে খবর আমরা কমই দেখতে পেয়েছি৷ এটি অবশ্য নির্বাচনী কাভারেজের উপমহাদেশের গণমাধ্যমগুলোর চিরাচরিত সমস্যা৷ ইউরোপের সংবাদমাধ্যমগুলো যে কোনো নির্বাচনে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অভিবাসীর মত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো নিয়ে সাধারণ ভোটারদের চাওয়া-পাওয়ার হিসেবে-নিকেশ তুলে ধরে৷ কিন্তু বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর গণমাধ্যমগুলো নির্বাচনে ব্যক্তিকেন্দ্রিক কাভারেজ বেশি দিয়ে থাকে৷ সাধারণত প্রধান দুটি দলের প্রধানকে একই রকম কাভারেজ দেয়ার মাধ্যমে এক ধরনের আরেপিত ভারসাম্য আনয়নের চেষ্টা করে থাকে এই অঞ্চলের গণমাধ্যমগুলো৷ কিন্তু এবারের লোকসভা নির্বাচনের কাভারেজের ক্ষেত্রে চিরাচরিত এই ব্যক্তিগত কাভারেজের আরোপিত ভারসাম্য থেকে ভারত ও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো সরে এসেছে৷ বেশিরভাগ গণমাধ্যমে ব্যক্তিকেন্দ্রিক কাভারেজের ক্ষেত্রে ‘মোদী ম্যাজিক‘ই মূখ্য প্রতিপাদ্য হয়ে উঠেছে৷ সেখানে বিরোধী দল ও নেতাদের ইস্যু খুব কমই গুরুত্ব পাচ্ছে৷ বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে 'মোদী ম্যাজিকের' যতটা কাভারেজ আমরা দেখতে পাই ‘চৌকিদার চোর হ্যায়' ইস্যুতে এসব গণমাধ্যমকে ততটায় নীরব থাকতে দেখি৷ কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারের পর যখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো সরব ছিল তখন বাংলাদেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো অপেক্ষাকৃত বিষয়টি নিয়ে কম আগ্রহই দেখিয়েছে৷ ফলে নির্বাচন সংক্রান্ত গণমাধ্যমের উপস্থাপনার পূর্বশর্ত – ভারসাম্য রক্ষিত হচ্ছে না৷ মোদি বিরোধী বা তার জন্য নেতিবাচক কিছু খবরও বাংলাদেশের অল্প কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে৷ তবে মোদির বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো যখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগ তুলেছিল তখন এই ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রধানসারির গণমাধ্যমগুলোর নীরবতা লক্ষ্যণীয়৷  

ভারতের লোকসভা নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের পরিবেশনার আরেকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো চলতি নির্বাচনে ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আলোচিত গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত ইস্যুর তুলনায় সাদামাটা খবর প্রকাশের প্রবণতা বেশি৷ যেমন – ভুল ও অপতথ্যের ছড়াছড়ি ভারতের এই নির্বাচনের জন্য গ্রহণযোগ্যতার জন্য একটি প্রধান সমস্যা৷ ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে এ নিয়ে খবর ও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে এ ধরনের খবর চোখে পড়ে না৷ ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ইস্যু হলো বেকারত্ব সমস্যা৷ এই ইস্যুতে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মাঠ বেশ উত্তপ্ত হলেও বাংলাদেশের গণমাধ্যমের খবরে এটি একেবারেই অনুল্লেখ্য ইস্যু হিসেবে থেকেছে৷

মোদীর কিসের ভয়?

আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, ভারতীয় নির্বাচনের খবরের উৎস হিসেবে বাংলাদেশি গণমাধ্যমগুলো ভারতীয় সংবাদমাধ্যম থেকেই বেশি খবর সংগ্রহ করছে৷ এক্ষেত্রে ভারতের গণমাধ্যম ব্যবস্থায় যেসব গণমাধ্যম বর্তমান ক্ষমতাসীন বিজেপির আস্থাভাজন সেগুলোর খবরের বরাত দিয়ে বাংলাদেশি বেশিরভাগ গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হতে দেখা যাচ্ছে৷ সাধারণত বাংলাদেশি গণমাধ্যমগুলো আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ইউরোপ ও আমেরিকার সুপ্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমগুলোর বরাত দিয়ে খবর প্রচার করে থাকে৷ কিন্তু ভারত ইস্যুতে এসব আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো মোদি ও বিজেপি বিরোধী বলে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবছর ধরে প্রচার করা হচ্ছে৷ ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর নির্বাচনী কাভারেজ নিয়ে গবেষকদের একটি অভিযোগ হলো, ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো নেতা-নেত্রীদের মুখনিঃসৃত বক্তব্য নির্ভর বা একটি সূত্রের ওপর ভিত্তিতে খবর প্রকাশ করে থাকে৷ এর ফলে প্রায়ই ভিত্তিহীন অভিযোগ এতটা প্রকাশ বা প্রচার হয় যে ভোটারদের মধ্যে ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ে এবং তারা বিভ্রান্ত হয়৷ বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো এসব ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে যখন খবর প্রকাশ করে তখন এদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতেও একই চিত্র ফুটে উঠে৷ আঞ্চলিক ইস্যুর দিক থেকে এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যা ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে অভিবাসীদের নিয়ে নানা আলোচনা থাকলেও বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এসব খবর খুব একটা প্রকাশিত হয় না৷

মোটাদাগে ভারতের লোকসভার কাভারেজ বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোকে তিনভাগে ভাগ করা যেতে পারে৷ বেশিরভাগ গণমাধ্যম 'মোদী ম্যাজিকে'র প্রতি ভারতের জনগণ যে এখনও আস্থাশীল সেটি প্রচার করছে৷ যেমন – বাংলাদেশের একটি প্রভাবশালী দৈনিকের শিরোনাম ছিল অসন্তোষ বাড়লেও ভারতের জনগণ এখনও মোদীকেই চায়৷ খুব কম সংখ্যক হলেও আরেক ধরনের সংবাদমাধ্যম আছে যারা মূলত মোদীবিরোধী খবরকেই প্রাধান্য দিচ্ছে৷ এক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম ইস্যু, মোদীর ঘৃণা ছড়ানো বক্তব্যকে গুরুত্ব দিয়ে তারা প্রচার করে৷ তৃতীয় দফা ভোটগ্রহণের পর এসব সংবাদমাধ্যমের প্রধান শিরোনাম ছিল মোদী ম্যাজিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ভারতীয় জনগণ৷ তবে কিছু প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম মোদীর পক্ষে-বিপক্ষে সংবাদ ও মতামতধর্মী নিবন্ধ প্রকাশের মধ্য দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করছে৷ তবে তিন ধরনের সংবাদমাধ্যমেই বিরোধী দল ও ভারতের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ঝড় তোলা ইস্যুগুলো নিয়ে খবর ও বিশ্লেষণ আমরা খুব কম দেখতে পাই৷ 

আধুনিক শাসন ব্যবস্থায় স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ছাড়া অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ ও অর্থবহ নির্বাচন হতে পারে না৷ এখানে গণমাধ্যম ও রাজনীতির স্বাধীনতা একে অপরের পরিপূরক৷ বিষয়টি মুরগী আগে না ডিম আগে – এমন বিতর্কের মত৷ কারণ স্বাধীন গণমাধ্যম ছাড়া যেমন অর্থবহ নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, তেমনি গণমানুষের রাজনৈতিক স্বাধীনতা না থাকলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও থাকে না৷ কে কার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে সেটি একটি দেশের রাজনৈতিক ও গণমাধ্যম সিস্টেমের ওপর নির্ভর করে৷ তবে পূর্ণ গণতন্ত্র, ভঙ্গুর বা শংকর গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র – শাসন ব্যবস্থা যেমন হোক না কেন বা যে ধরনের রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থায় নির্বাচন হোক না কেন, প্রত্যেকটি জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে গণমাধ্যমের কিছু স্বকীয় ও বিশেষ ভূমিকা থাকে৷ এখানে গণমাধ্যমকে দুদিকে ধারওয়ালা তলোয়ারের মত কাজ করতে হয়৷ একদিকে তথ্যের জন্য গণমাধ্যমকে প্রার্থী ও রাজনৈতিক দল, ভোটার এবং নির্বাচন পরিচালনা প্রশাসনের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে হয়৷ অন্যদিকে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট এসব পক্ষের অনিয়ম তুলে ধরে নিরপেক্ষ ও অর্থবহ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হয়৷ স্থানীয় হোক বা আন্তর্জাতিক যে কোনো নির্বাচনের ক্ষেত্রে তথ্যের সত্যতা, সব পক্ষের সমান গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন এবং তথ্য ও মন্তব্যের স্পষ্টতা নিশ্চিত করে গণমাধ্যমকে বস্তুনিষ্ঠতার প্রমাণ দিতে হয়৷ ভারতের লোকাসভা নির্বাচন এখন আর কোনোভাবেই অভ্যন্তরীণ একটি বিষয় নয়৷ বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশি দেশগুলোর জন্য এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু৷ সেজন্য বাংলাদেশের গণমাধ্যমের অবশ্যই এই ইস্যুতে পক্ষপাতমূলক বা একটি পক্ষের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করা সমীচীন হবে না৷ এটি বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থ এবং দু'দেশের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতির ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে৷