বাংলাদেশের চলমান অস্থিরতায় ভারত নীরব কেন?
১ আগস্ট ২০২৪সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে রাজপথে নেমে এসেছে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা৷ কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা এই আন্দোলনে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে সরকারি হিসেব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ১৫০ জন নিহত হয়েছেন, যদিও গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে মৃতের সংখ্যা দুইশরও বেশি বলে দাবি করা হয়েছে৷
অন্যতম বন্ধু বাংলাদেশে চলমান এই অস্থিরতার দিকে নজর রাখছে ভারত৷ তবে ভারত সরকারের কার্যকলাপে যেন চলমান অস্থিরতায় কোনো নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সে বিষয়েও সতর্ক দিল্লি৷
এক সাপ্তাহিক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘‘চলমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বিবেচনা করছে ভারত৷ বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় ভারতীয় শিক্ষার্থীরা যেন নিরাপদে দেশে ফিরতে পারে সেই আয়োজন আমরা করতে পেরেছি৷''
উল্লেখ্য, চলমান পরিস্থিতির কারণে অন্তত ৬,৭০০ ভারতীয় শিক্ষার্থীবাংলাদেশ থেকে ভারতে ফিরেছেন৷
ভারত সরকারের পরারষ্ট্র বিষয়ক মুখপাত্র আরো বলেন, ‘‘নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে যার সাথে আমাদের উষ্ণ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে, আমরা আশাবাদী যে, সে দেশের (বাংলাদেশের) পরিস্থিতি দ্রুতই স্বাভাবিক হবে৷''
নিরাপত্তা, বাণিজ্য এবং কূটনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব
ভারতের কাছে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার মানে হলো শেখ হাসিনা সরকারের দৃঢ়ভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকা৷ ভারতের এমন চাওয়ার অন্যতম কারণ নিরাপত্তাজনিত স্বার্থ৷ দেশ দুটির চার হাজার ১০০ কিলোমটিরের যৌথ সীমানা রয়েছে৷ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজোরাম রাজ্যের সাথে বাংলাদেশের সীমানা রয়েছে৷
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রতিবেশী দেশে জনসমর্থন এবং শুভাকাঙ্খী গড়ে তুলতে ভারত বিনিয়োগ করেছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ এই উপ-অঞ্চলের, অর্থাৎ বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত নেপাল, উন্নয়নের অংশীদার হয়ে উঠেছে৷ এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের উত্তর এবং পূর্বাঞ্চল সংলগ্ন ভারতের রাজ্যগুলো৷ ভারতের এই রাজ্যগুলো অবিভক্ত ভারতের সরবরাহ ব্যবস্থার সাথে যুক্ত ছিল৷
তার মতে, ‘‘আর এখন বাংলাদেশ এবং ভারত দুই দেশের মধ্যে পরিবহণ যোগাযোগ শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে এবং অবিভক্ত ভারতের সময়ের ব্যবস্থাকে পুনরায় চালু করতে চাইছে৷''
ঢাকায় বিলিয়ন ডলার
বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে ভারত ঋণ সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে৷ এই পর্যন্ত ঢাকাকে ৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ (লাইন অব ক্রেডিট) প্রদান করেছে দিল্লি৷ ঋণের এই অর্থ দিয়ে নানা উন্নয়ন প্রকল্প, যেমন অবকাঠামো নির্মাণ, ডিজেল সরবরাহের জন্য পাইপলাইন নির্মাণ , ইত্যাদির কাজ করছে ঢাকা৷
এদিকে ভারতের বড় বড় কোম্পানিগুলোও বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে৷ এর মধ্যে রয়েছে মারিকো, ইমামি, ডাবর, এশিযান পেইন্টস এবং টাটা মোটর্স৷ ছাত্র আন্দোলনের এই অস্থিরতা সরাসরি এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে৷
জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের সঞ্জয় ভরদ্বাজ বলেন, ‘‘ভারত এবং বাংলাদেশের সম্পর্ক দুই দেশের সমন্বিত ইতিহাস, জটিল সামাজিক-অর্থনৈতিক আন্তঃনির্ভরতা এবং দেশ দুটির ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের মধ্যে নিহিত রয়েছে৷ যে-কোনো ধরনের সংঘাতের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা এই অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদের সমস্যা, মৌলবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং অভিবাসনের পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে৷''
চীন-ভারতে আবদ্ধ
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও চীন উভয় দেশই বাংলাদেশে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থান বৃদ্ধি করেছে৷ ফলস্বরূপ, দেশ দুটোর মধ্যে বাড়ছে ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব৷
বাংলাদেশের সাথে নিবিড় সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা থাকলেও কোনো কোনো বিশ্লেষক বলছেন, ভারতের নীতিনির্ধারকদের বাংলাদেশের একটি অংশের মানুষের মধ্যে থাকা ভারতবিরোধী মনোভাবকে বুঝতে বেগ পেতে হচ্ছে৷ এর কিছুটা অবশ্য বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি নতুন দিল্লির সমর্থন বিশ্লেষণ করে বোঝা যেতে পারে৷
এ বিষয়ে গবেষণা ফোরাম মন্ত্রয়া-এর শান্তি মারিয়েট ডি'সুজা বলেন, ‘‘এই অস্বস্তিকর নীরবতা হলো হাসিনা সরকারের প্রতি এবং চলমান অস্থিরতাকে সামলাতে সরকারের নীতির প্রতি ভারতের নীরব সমর্থন৷ গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে ভারতঘেঁষা শক্তি হিসেবে আওয়ামীলীগকে ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা করেছে ভারত৷''
এদিকে সরকারের সমালোচকদের দাবি, শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে একটি একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন৷
শান্তি মারিয়েট ডি'সুজা বলেন, ‘‘নির্বাচনকে গণতান্ত্রিক এবং স্বচ্ছ করতে বিরোধীদের দাবি বাস্তাবয়নে মার্কিন সরকারের চাপ থেকে হাসিনা সরকারকে সুরক্ষা দিয়েছে ভারত৷ বর্তমান নীরবতা হলো ওই নীতির ধারাবাহিকতা৷''
বড় পরিসরে ভাবনা ভারতের
শান্তি মারিয়েট ডি'সুজার মতে, নানা কৌশলগত কারণে বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে থাকে ভারত৷ এর মধ্যে রয়েছে দেশটির উত্তর-পূবাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর উন্নয়ন, ভারতে অভিবাসন বন্ধ করা, এবং ইসলামি মৌলবাদ ঠেকানো৷
তিনি বলেন, ‘‘দেশটিতে ব্যাপক চীনা বিনিয়োগ সত্ত্বেও নতুন দিল্লি হাসিনাকে এমন একজন হিসেবে বিবেচনা করে থাকে, যিনি বাংলাদেশকে বেইজিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়া থেকে বিরত রাখবেন৷ এর ফলে তাকে সমর্থন করা দিল্লির একমাত্র কৌশল৷ এমনকি যদিও তার নেওয়া নীতি কখনো কখনো কর্তৃত্ববাদীঘেঁষা হয়ে থাকে৷''
এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে হাসিনা সরকারের সাম্প্রতিক ব্যর্থতা এবং সেইসাথে বিএনপি ও ইসলামিস্ট দলগুলোর শক্তিশালী অবস্থান ভারতের জন্য খুব একটা ভালো সংবাদ নয়৷
তবে এ বিষয়ে ভারতের জিন্দাল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের প্রফেসর শ্রীরাধা দত্ত মনে করেন, শিক্ষার্থীদের প্রতি হাসিনা সরকারের চরম প্রতিক্রিয়া কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়৷
সহিংসতার সব দায় বিরোধী দল এবং ইসলামিস্টদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার যে চেষ্টা তারও সমালোচনা করেন তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘সরকারের কোনো প্রতিক্রিয়া না থাকা এবং সেই সাথে অপমানজনক মন্তব্য করার কারণে আন্দোলন সহিংস হয়ে উঠেছে৷''
মুরলি কৃষ্ণাণ/আরআর