বাড়ছে ভর্তুকি, উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা সংকটেও
২১ ডিসেম্বর ২০২২জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরা হচ্ছে আগের মতোই, ৭ দশমিক ৫ শতাংশ।বাজেটের আকার বাড়ছে ৬২ হাজার কোটি টাকা৷
- ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য সাড়ে ৭ শতাংশ৷
- মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ৫.৬ শতাংশ থেকে বেড়ে হবে ৭.৫ শতাংশ৷
- ভর্তুকিই দিতে হতে পারে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি৷
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ৷ আগামী অর্থবছরের জন্যও একই হার ধরার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷ তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির বর্তমান অবস্থাকে প্রায় মেনে নিয়েছে সরকার৷ চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ৷ আগামী অর্থবছরের জন্য তা ২ শতাংশ বাড়িয়ে করা হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ৷
গতকাল মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে জুম প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রাবিনিময় হারসংক্রান্ত সমন্বয় কাউন্সিলের বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে৷
৭ দশমিক ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রাকে যৌক্তিক বলেই মনে হচ্ছে৷ তবে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারের লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ অবাস্তব, যেখানে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির তেমন কোনো আয়োজন নেই৷
মো. আজিজুল ইসলাম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা
বৈঠকে চলতি ও আগামী অর্থবছরের বাজেটের নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়৷ বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ প্রমুখ এতে অংশ নেন৷ সূত্রগুলো জানায়, এক বছর পর আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন৷ আগামী বাজেট প্রণয়নে তাই জনপ্রিয় কিছু কর্মসূচি হাতে নেওয়ার কথাও ভাবা হয়েছে৷
অর্থনীতিবিদেরা অবশ্য প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির হারের লক্ষ্যমাত্রার হার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন৷ তাঁরা বলছেন, সরকারের প্রাক্কলনের সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতির তেমন মিল নেই৷
সূত্র জানায়, বৈঠকে আলোচনা উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা সাধারণ মানুষের অবস্থা নিয়েও আলোচনা হয়েছে৷ আলোচনা হয়েছে ডলার-সংকট ও ডলারের অস্বাভাবিক দাম নিয়ে৷ জানানো হয়েছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার কয়েক দফায় আমদানি কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছে৷ এতে রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে৷ এ ছাড়া প্রবাসী আয়ে (রেমিট্যান্স) একই জায়গায় আটকে আছে দেশ৷ রপ্তানি প্রবৃদ্ধিও আশানুরূপ নয়৷ আবার নতুন করে যুক্ত হচ্ছে ভর্তুকির বাড়তি চাপ৷ সার, বিদ্যুতের ভর্তুকির পাশাপাশি ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে বছরব্যাপী তেল, চিনি বিক্রিতেও ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে৷ আগামী অর্থবছরে ভর্তুকিই দিতে হতে পারে এক লাখ কোটি টাকার বেশি৷
জানা গেছে, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার বাজেট করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷ চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা থেকে তা ৭২ হাজার কোটি টাকা বেশি৷ সূত্র জানায়, যেসব প্রক্ষেপণ করা হয়েছে, তা চূড়ান্ত নয়৷
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রাবিনিময় হারসংক্রান্ত সমন্বয় কাউন্সিলের প্রথম বৈঠক এটি৷ বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২ অনুযায়ী, প্রতি অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে৷ গতকালের বৈঠকের আলোচ্যসূচি ছিল দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের অগ্রগতি এবং বিশ্ব ও জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিমধ্যে সূচিত পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামো (এমটিএমএফ) পর্যালোচনা এবং চলতি অর্থবছরসহ ২০২৩-২৪ থেকে ২০১৫-২৬ অর্থবছর পর্যন্ত এমটিএমএফের সূচকগুলোর প্রক্ষেপণের ওপর আলোচনা৷ সূত্রগুলো জানায়, বেশি আলোচনা হয় মূল্যস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধির হার নিয়েই৷
প্রবৃদ্ধি একই, মূল্যস্ফীতি ২% বেশি
চলতি অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ৷ বৈঠক সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, আগামী অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারও একই অর্থাৎ ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷
তবে গত অক্টোবরে বিশ্বব্যাংক বলেছে, চলতি অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ১ শতাংশ৷ তার আগে সংস্থাটি পূর্বাভাস দিয়েছিল, এ প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ৷ বিশ্বব্যাংক আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হারের প্রাক্কলন করেছে গত অক্টোবরে ৬ দশমিক ২ শতাংশ৷
বিশ্বব্যাংকের মতে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে করোনা মহামারির অভিঘাত থেকে বাংলাদেশের পুনরুদ্ধার ব্যাহত হবে। প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার এটাই হবে অন্যতম কারণ৷
বিশ্বব্যাংকের চেয়ে আরেক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রাক্কলন একটু বেশি হয় সব সময়, যা সরকারি লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি থাকে৷ এডিবি বলেছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হবে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ৷
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয় চলতি পঞ্জিকা বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে৷ আর চলতি অর্থবছরের বাজেট করা হয় জুনে৷ বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৫ দশমিক ৬ শতাংশ৷ দুই মাসের মাথায় এ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি ওঠে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে৷ সেপ্টেম্বরে তা ৯ দশমিক ১০ শতাংশে নেমে আসে এবং অক্টোবরে নেমে আসে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশে৷ প্রবণতা নিম্নমুখী৷ সে বিবেচনায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় ২ শতাংশ বেশি৷
বৈঠক সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যগুলো বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনকে জানালে তিনি বলেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের নিচে নামলেও ওষুধ, কাপড়সহ খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি এখনো ১০ শতাংশের কাছাকাছি৷ কৃচ্ছ্রের কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু কৃচ্ছ্রতাটা কোথায়? আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমছে ভালো৷মূল্যস্ফীতি কমানোর অভ্যন্তরীণ কৌশলও তো থাকতে হবে৷ কিন্তু দেখছি সরকার এ ফাঁকে ব্যাংক খাত থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেওয়ার কারণ হবে৷ সুতরাং আগামী বাজেটে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরার বিবেচনাটা বোধগম্য নয়৷
রাজস্ব আয় বাড়বে না, আবার প্রবৃদ্ধি ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ৷ এ হারকে বেশি বলেই মনে করছেন জাহিদ হোসেন৷ তিনি বলেন, ‘৭ দশমিক ৫ তো শক্তিশালী অর্থনীতির নির্দেশক৷ ছয় মাসে কী দেখলাম? এখন বলা হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা টাকা ফেরত দিতে পারছেন না৷ সরকারের প্রাক্কলনের সঙ্গে বাস্তব অঙ্ক কিছুতেই মিলছে না৷'
রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে না
চলতি অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা৷ এর মধ্যে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা৷ আর এনবিআর-বহির্ভূত করব্যবস্থা থেকে রয়েছে ৬৩ হাজার কোটি টাকা৷ বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা মেটানো হবে ব্যাংকঋণ, বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের অর্থে৷
সূত্র জানায়, গতকালের বৈঠক থেকে সিদ্ধান্ত এসেছে যে আগামী অর্থবছরের জন্য রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হবে না৷ ২০২০-২১ অর্থবছরে এনবিআরের অর্জন লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছিল৷ পরেরবার অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরেও এ লক্ষ্যমাত্রা একই ধরা হয়েছিল৷
সূত্রগুলো জানায়, আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ধরা হবে ৬ শতাংশ৷ চলতি অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ৷ এ ছাড়া আগামী অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হচ্ছে তিন লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি৷
দুটি বাজেট উপস্থাপন করা সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম এসব নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ৭ দশমিক ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রাকে যৌক্তিক বলেই মনে হচ্ছে৷ তবে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারের লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ অবাস্তব, যেখানে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির তেমন কোনো আয়োজন নেই৷
প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা একটু বেশি থাকলে অসুবিধা কোথায়—এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জ্জা আজিজ বলেন, ‘অর্থনীতির তথ্য-উপাত্তেরবিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে তখন প্রশ্ন ওঠে৷ যেমন প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থান সম্পর্কিত৷ দেখা গেল প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেখালাম, কিন্তু মানুষ কাজের অভাবে ভুগছে৷ উচ্চ প্রবৃদ্ধির কথা বলে অহেতুক আশার সঞ্চার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার কোনো মানে নেই৷'
এনএস/কেএম (প্রথম আলো)