ব্যাংকে তারল্য কমার তিন কারণ
২১ ডিসেম্বর ২০২২মঙ্গলবার ব্যাংকিং খাতে তারল্য পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছ, ঋণের প্রকৃত সুদহার কমে যাওয়া, করোনাভাইরাস মহামারির বিধিনিষেধ কমে এলে অর্থনীতির জোরালো কর্মকাণ্ডে ঋণ বাড়া এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিদেশি মুদ্রা বিশেষ করে ডলার কেনার কারণে ব্যাংক ব্যবস্থায় থাকা তারল্য বা নগদ টাকার পরিমাণ কমে এসেছে৷
সবশেষ হালনাগাদ এ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে বিশেষায়িত ব্যাংক ছাড়া দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা৷ ২০২১ সালের একই সময়ে যা ছিল ৪৩ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা৷ এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ২৮ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা; শতকরা হিসাবে ৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ৷
এর তিন মাস আগে জুন শেষে এ অঙ্ক ছিল ৪৩ হাজার ১৯২ কোটি ৯০ লাখ টাকা৷ তিন মাসের ব্যবধানে তারল্যের পরিমাণ কমেছে ১ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা৷
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্য রয়েছে৷ তবে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা প্রবাহ ব্যাংকের বর্তমান তারল্য ব্যবস্থায় আরও চাপ তৈরি করেছে। সম্প্রতি ব্যাংক দেউলিয়া যাবে এমন গুজব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হিড়িক পড়ে৷ এ নিয়ে কথা বলতে হয় সরকারপ্রধানকেও৷ এ গুজবে কান না দিতে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে আহ্বান জানান৷
অপরদিকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশসহ শরিয়াহভিত্তিক আরও কয়েকটি ইসলামি ব্যাংকে বড় ঋণ বিতরণের অনিয়মের খবর সংবাদ মাধ্যমে এলে সেগুলো থেকেও টাকা তোলার লাইন পড়ে যায়৷ এমন পরিস্থিতিতে তারল্যে টান পড়লে সাত ইসলামি ব্যাংক টাকা ধার নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে৷
তবে সার্বিক তারল্য কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে ঋণের সদুহার কমে যাওয়ার প্রভাবের বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে৷
সরকারের নির্দেশনা মেনে ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক৷ আমানতের সুদহারও প্রথমে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ পরে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মিল রেখে নির্ধারণের নির্দেশনা দেওয়া হয়৷
সুদহার কমে আসার কারণে এরপর থেকে ঋণের চাহিদা বাড়তে থাকে৷ মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার পেছনে এটি ভূমিকা রাখে৷ এর সঙ্গে ভোগ্যপণ্যের উচ্চমূল্য যোগ হলে গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯.৫২ শতাংশে উঠে- যা গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ৷
এমন প্রেক্ষাপটে আগে থেকে চড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি বাগে আনতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে মুদ্রা সরবরাহ আরও কমিয়ে আনার পদক্ষেপের অংশ হিসেবে গত জুনে রেপো সুদহার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করা হয়৷
একই সঙ্গে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে এনে বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি ২০৯২২-২৩ অর্থবছরের নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করে৷ চলতি অর্থবছরের জন্য বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ৷
এসব পদক্ষেপের মধ্যেই বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বেড়েছে; ব্যাংক ব্যবস্থায় তারল্য কমার ক্ষেত্রে এটিকে বড় কারণ হিসেবে ব্যাংকাররা৷ ব্যাংকিং খাতে তারল্য প্রবাহ কমে যেতে পারে বলে আগে থেকেই বলে আসছিলেন অর্থনীতিবিদরা৷
মঙ্গলবার গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআই এর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মানুষ ব্যাংকে সঞ্চয় করে সুদ পেত৷ মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় যা এখন অনেক কম, বলা যায় ‘প্রকৃত সুদহার ঋণাত্বক' হয়ে গিয়েছে ব্যাংকে৷ সুদ না পেলে মানুষ অন্য কোথাও অর্থ খরচ করবে৷ এতে ব্যাংকেও তারল্য সংকট তৈরি হবে৷
ব্যাংকে অর্থ ফিরিয়ে আনতে আমানতে সুদহার বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি৷
বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক প্রতিবেদন বলছে, গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে গিয়েছে দুই লাখ ৩৯ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা, যা জুন শেষে ছিল ২ লাখ ৩৬ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা৷
ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে চলে যাওয়া এ পরিমাণ অর্থ এখন নগদ আকারে মানুষের হাতে আছে৷ অথচ দেশে অনলাইন লেনদেন ব্যবস্থার পরিধি বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ ব্যাংকরা মানুষের নগদ অর্থের ব্যবহার কমবে বলে আশা করছিলেন৷
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতির প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের পাশাপাশি ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণও বেড়েছে৷
গত সেপ্টেম্বর শেষে অভ্যন্তরীণ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি দঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ৪২ শতাংশ৷ এ সময়ে অভ্যন্তরীণ ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা৷ তিন মাস আগে জুনে ছিল ১৬ লাখ ৭১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা৷ আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় গত সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ৷
প্রতিবেদনে বলা হয়, আমদানি ব্যয়ের তুলনায় রপ্তানি ও রেমিটেন্সের পরিমাণ কম হওয়ায় সার্বিক লেনদেনে ভারসাম্যে ঘাটতির পরিমাণ আগের প্রান্তিকের তুলনায় বেড়েছে৷ এটি টাকার বিনিময় হারে এবং বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে৷
বড় অঙ্কের আমদানি দায় মেটাতে গিয়ে বাংলাদেশে ব্যাংকে সংরক্ষিত রিজার্ভ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করায় বিদেশি মুদ্রার মজুদ গত ১৪ ডিসেম্বরের হিসাবে ৩৩ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে, সেপ্টেম্বরে যা ছিল ৩৬ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার৷
এনএস/কেএম (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)