বাধা আছে, তবু তাঁরা এগিয়ে যাচ্ছেন
২ জুলাই ২০১৮হৃদস্পন্দন তখনও কমেনি৷ আধো আলো আধো ছায়া পার হয়ে দরজার চৌকাঠ পার হয়ে ঢুকতেই বিস্ময়ের ঘোরে রীতিমতো হাবুডুবু খেলাম৷ বাসার পাটাতনের মেঝের ফাঁক গলে দেখা যাচ্ছে ডোবার পানি৷ অথচ এমন এক জায়গায় থেকেই কিনা এসএ গেমসে ভারোত্তলনের ৬৩ কেজি ওজনশ্রেণিতে দেশকে স্বর্ণপদক এনে দিলেন সীমান্ত!
কী করে সম্ভব হলো? প্রশ্নটা যেতেই স্বর্ণকন্যার জবাব, ‘‘গেমসে যাওয়ার ঠিক এক সপ্তাহ আগে হাতে ব্যথা পেয়েছিলাম৷ বাবা-মায়ের মনোবল ভেঙে গিয়েছিল৷ আমি যে খেলাটা খেলি, সেখানে আসলে হাতের জোরটাই আসল৷ বাবা বললেন, ‘‘এই ব্যথা নিয়ে খেলতে যাবি?'' বললাম, ‘‘বাবা আমি যদি মেডেল না নিয়ে দেশে ফিরি, তাহলে ওখানে হাত ফেলে চলে আসবো৷ আসলে মনোবল থাকলে মানুষ অনেক কিছুই করতে পারে৷''
সত্যিই তাই৷ বাংলাদেশের নারীদের ক্রীড়াক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার মূল টনিকটাই এটা৷ এখানকার সামাজিক আর ধর্মীয় প্রেক্ষাপট এখনো নারীকে ক্রীড়াঙ্গনে দেখতে অভ্যস্ত হতে পারেনি৷ মাবিয়ার বেলাতেই যেমন৷ আত্মীয়স্বজনরা একটা সময় একরকম সম্পর্ক ছিন্নই করে ফেলেছিলেন৷ তবু তিনি এগিয়ে গেছেন একান্ত নিজের ইচ্ছায়৷
কথা হচ্ছিল বাংলাদেশের একমাত্র নারী ঘোড়সওয়ারি তাসমিনা আক্তারের সাথে৷ লিকলিকে গড়নের মেয়েটিকে দেখলে বোঝার উপায় নেই ১০ বছর বয়স থেকেই দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘোড়া নিয়ে দাবিয়ে বেড়াচ্ছেন৷ কী সহজ সরল তাঁর কথা-ভাষা৷ প্রতিভা আছে, তবে প্রতিকূলতা আর্থিক জায়গাটায়, যদিও স্বপ্নের পরিধিটা অনেক বড়৷ সাহায্য পেলে বিদেশেও ঘোড়া নিয়ে দৌড়াতে চান৷ নঁওগা জেলার দরিদ্র পরিবারের মেয়ে তাসমিনার বাবার একটি ঘোড়া ছিল৷ সেটি চালিয়ে পাঁচ বছর বয়সেই ঘোড়া চালানো শিখলেও অভাবের কারণে সেটি বিক্রি করে দেন৷ কিন্তু তাসমিনা থেমে না গিয়ে অন্যদের সাহায্য নিয়ে এগিয়েছেন৷
ক্রীড়া সাংবাদিকতার সুবাদে বহুদিন ধরে নারীদের খেলাধুলা নিয়ে কাজ করছি৷ অভিজ্ঞতায় বলছি, এই পর্যন্ত যেসব নারী বাংলাদেশের সুনাম বহির্বিশ্বে ছড়িয়েছেন তাঁদের সকলকেই কোনো-না-কোনো প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে৷ নারী বলেই তাঁদের এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা এসেছে৷
এমনই আরেকজন কক্সবাজারের সার্ফার নাসিমা আক্তার৷ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় ছেলেদের হারিয়ে তিনি বিদেশিদের রীতিমতো চমকে দিয়েছিলেন, তাঁকে বাংলাদেশের নারী সার্ফারদের পথিকৃতও ধরা হয়৷ মুসলিম ঘরের এক কিশোরীকে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউকে জয় করতে দেখে বিশ্ব মিডিয়ায় তাঁকে নিয়ে সাড়া পড়ে গিয়েছিল৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত নির্মাতা হিথার কিসিঞ্জার তাঁকে নিয়ে তৈরি করেন ‘দ্য মোস্ট ফিয়ারলেস' বা ‘ভয়ডরহীন' ডকুমেন্টারি৷ যেই নাসিমাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ‘সানডে টাইমস', ‘দ্য গার্ডিয়ান' এবং অস্ট্রেলিয়ার ‘দ্য অস্ট্রেলিয়ান'-এ৷
নারী বিষয়ক আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন ‘ম্যারি ক্লেয়ারেও' প্রকাশিত হয় নাসিমার সচিত্র প্রতিবেদন৷ অথচ পরিবারের ইচ্ছে অনুযায়ী পতিতাবৃত্তি বেছে নিতে রাজি না হওয়ায় তাঁকে ঘড়ছাড়া হতে হয়েছিল মাত্র নয় বছর বয়সে৷ ‘সার্ফিং দ্য নেশন্স' নামের একটি সংগঠনের মাধ্যমে যখন এই খেলায় যোগ দেন, তখনও সমাজের বাঁকা চোখ আর তীর্যক মন্তব্য এফোড়-ওফোড় করেছে তাঁর হ্নদয়৷ তবু তিনি এগিয়েছেন অদম্য ইচ্ছে আর সার্ফিংয়ের প্রতি তাঁর ভালোবাসার টানে৷ নাসিমার পর এখন কক্সবাজারে নারী সার্ফারদের সংখ্যা ছাড়িয়েছে শ'য়ের কোঠা৷
তবে বিয়ের পর আর সার্ফিংয়ে অতটা মনোনিবেশ করতে পারেননি তিনি৷ শ্বশুর-শাশুড়ি-স্বামীর বাধা, সঙ্গে জীবন সংগ্রামে নতুন যুদ্ধ৷ সংসার চালানোর তাড়না৷ একটা সময় সমুদ্র থেকে তুলে আনা শামুক-ঝিনুকের খোলস বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করাতেই বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েন৷ তবু সার্ফিংয়ের কোনো কিছু হলেই কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে চলে আসেন নাসিমা৷ শেষবার যখন কথা হয় তাঁর সাথে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমি চাই মানুষ তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাক৷ শুধুমাত্র মানসিক সহযোগিতা পেলেই আমরা নারীরা দেশের জন্য অনেক সুনাম নিয়ে আসতে পারবো৷''
সমস্যা ঐ মানসিকতাতেই৷ বাংলাদেশের খেলাধুলায় আসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা লিঙ্গবৈষম্য৷ একজন পুরুষকে যেভাবে দেখা হয়, নারীকে সেভাবে স্বাগত জানানো হয় না৷ তাঁদের দুর্বল, শক্তিহীন, প্রতিযোগীতায় অক্ষম হিসেবে দেখা হয়৷
সালমা খাতুন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বর্তমান টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক৷ শুরুতে যখন ব্যাট-বল হাতে মাঠে নামতেন, আশপাশের মানুষ টিপ্পনি কাটতো৷ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে তারা বলতো, ‘‘এই হ্যাংলা-পাতলা মেয়ে নাকি ক্রিকেটার হবে৷'' সেদিন যদি ‘পাছে লোকে কিছু বলে' শুনতেন আজ সালমার হাতে শোভা পেতো না নারীদের এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ট্রফি৷ এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘‘থ্রি-পিস পরে যখন খেলতাম, লোকে হাসতো৷ কখনোই মন খারাপ করতাম না৷ কটু কথায় কান দিতাম না৷ অথচ দেখেন এখন তারাই উৎসাহ জোগান আরো ভালো করতে৷'' সালমা খাতুন বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের ব্র্যান্ড৷ এখন তাঁকে দেখে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েরাও বলতে পারছেন ‘‘আমিও ক্রিকেটার হবো৷''
অথচ আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এই যে, ক্রিকেটে সাফল্য আনা নারীরা খোদ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেরই বৈষম্যের শিকার৷ অনিয়মিত ক্যাম্প, প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচিতে উদাসীনতা, দেশের বাইরে সিরিজ খেলা নিয়ে পরিকল্পনার অভাব তো রয়েছেই৷ সবচেয়ে বড় বৈষম্য ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁদের ম্যাচ ফি-তে৷ যেখানে ছেলেদের জাতীয় লিগের প্রথম স্তরে ম্যাচ ফি ২৫ হাজার টাকা, দ্বিতীয় স্তরে ২০ হাজার টাকা৷ মেয়েদের সেখানে মাত্র ৬০০ টাকা৷ নারীদের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ যদিও ছেলেদের মতো বড় দৈর্ঘ্যের নয়৷ তবু বিশ্বের পঞ্চম ধনি ক্রিকেট বোর্ডের কাছ থেকে এ সম্মানিটা বড্ড বেমানান৷ মুখে যদিও নারী ক্রিকেটাররা কিছু বলতে চান না৷ ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গা থেকে বুঝেছি, বিষয়টি তাঁদের পীড়া দেয়৷ তবু তাঁরা আশাবাদী, ক্রিকেট বোর্ড এই মানসিকতার পরিবর্তন করবে৷
ক্রিকেটের চেয়ে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে এ মুহূর্তে সবচেয়ে সফলতা এসেছে নারীদের ফুটবলে৷ ছেলেরা যেখানে ব্যর্থতার ঘোরে ঘুরপাক খাচ্ছে, মেয়েরা সেখানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একের পর এক দেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন৷ সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা, সাফ আন্তর্জাতিক চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্সআপ হওয়া - সবমিলিয়ে মুহূর্তে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের কদরটা বেড়েছে৷
বাংলাদেশের নারী ফুটবল আজকের যে অবস্থানে এসেছে সেখানে অধিনায়ক সাবিনা খাতুনের অবদানটা কোনো অংশে কম নয়৷ দেশের প্রথম নারী ফুটবলার হিসেবে মালদ্বীপে গিয়ে যিনি চার ম্যাচে ৩৩ গোল করে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন সেখানকার ফুটবল অঙ্গনকে৷ এখন তাঁকে লোকে ‘গোলমেশিন' বলে৷ অথচ আগে তাঁকে দেখে মানুষ হাসতো৷ প্রতিনিয়ত পিছনে টেনে ধরতে চাইতো৷ তবে তাঁর ইচ্ছে আর অদম্য শক্তির কাছেই হার মেনেছে সমস্ত প্রতিকূলতা৷
তবু সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট নন সাবিনা৷ বলছিলেন, ‘‘একটা মেয়ে খেলাধুলা করে পরিবারকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য৷ কিন্তু বাংলাদেশে মহিলা ফুটবল দলে সেটা নেই বললেই চলে৷ এখানে মেয়েদের জন্য কোনো লিগ বা টুর্নামেন্ট হয় না৷ অথচ দেখেন ছেলেরা সব সুবিধাই পায়৷ তাই একটা মেয়ে কোন ভরসায় ফুটবলে ক্যারিয়ার গড়তে চাইবে, বলুন?'' তাঁর কথায় যুক্তি আছে৷
মেয়ে ফুটবলারদের সাফল্যের পর একবার অফিস আমাকে দায়িত্ব দিলো তাঁদের নিয়ে কাজ করার৷ সেই সুবাদে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের ক্যাম্পে গেলাম৷ সেখানে যে পরিবেশ আর তাঁদের যে খাবারের মান দেখলাম, তা দেখে রীতিমতো অবাক হয়েছিলাম৷ পুষ্টিগুণ বজায় রেখে পেশাদার ফুটবলারদের খাবার মেন্যু ঠিক করা হয় প্রতিটি দেশেই৷
বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের খাবারের মেন্যু চার্টে তাঁর কোনো অস্তিত্বই পেলাম না৷ যদিও অনেক লেখালেখির পর শুরুর দিকের সেই অবস্থার এখন অনেকটাই উন্নতি ঘটেছে৷ তবে যেসব মেয়ে বাংলাদেশের ফুটবলে এই মুহূর্তে এগিয়ে আসছেন, তাদের সার্বিক পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়৷ তার মূল কারণ পারিবারিক অবস্থা৷
বিষয়টি আমার নজরে আনেন মেয়েদের দীর্ঘদিনের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন৷ বলছিলেন, ‘‘মেয়েরা যখনই ক্যাম্প ছেড়ে বাড়িতে যায়, তারপর তাদের ফিটনেস নিয়ে প্রচুর কাজ করতে হয়৷ কারণ, সে সময়টা তারা তাদের পুষ্টিগুণের খাবার খায় না৷ আর এই জায়গাটাতেই আমাদের মেয়েরা অন্যদের থেকে পিছিয়ে থাকে৷ শারীরিক সক্ষমতার অভাবে আমাদের বিদেশি দলগুলোর সাথে প্রায়ই ভুগতে হয়৷'' আর এ অবস্থার মাঝেই এগিয়ে চলেছে ফুটবল৷ কারণ, খেলাকেই তারা তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে৷
নাহ! এত এত সাফল্যের পর এখনও নারীদের চলার পথ মসৃণ হয়নি৷ এখনো সমাজ, পারিপার্শ্বিকতা তাদের প্রতি হাসি মুখে হাত বাড়ায় না৷ এখনো ফেডারেশন, বোর্ড নারীদের সহযোগিতা দেয়ার পথে কার্পণ্য করে৷ তবু সালমা খাতুন, সাবিনা, মাবিয়া, নাসিমার মতো নারীরা এগিয়ে যান৷ আর তাঁদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের ফুটবল, ক্রিকেটসহ প্রতিটি ইভেন্টে নারীরা রেখে যাচ্ছেন সাফল্যের স্বাক্ষর৷
ব্লগ পোস্টটি কেমন লাগলো? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷