বনবিড়াল বাঁচাতে হাই-টেক
২৬ জুলাই ২০১৭ঘন জঙ্গল আর নির্জন উপত্যকা৷ বাভেরিয়ার অরণ্য জার্মানিতে মুক্ত, বন্য প্রকৃতির শেষ আশ্রয়গুলির মধ্যে অন্যতম৷ মাত্র এক হাজার বছর আগে এখানে মানুষের বসবাস শুরু হয়৷ আজ পর্যন্ত বিরল প্রাণীরা এখানে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পায়৷
লিনক্স নামের বনবিড়ালটি তাদের অন্যতম, যদিও লিনক্সরা আড়ালে থাকতেই ভালোবাসে – কাজেই তাদের ছবি তোলা দুরূহ কাজ৷ পাঁচ'শ বছর আগে লিনক্সরা ইউরোপের সব বনেজঙ্গলে ছড়িয়ে ছিল৷ শিকার আর মানুষের নিত্যনতুন বসতির কারণে এই বনবিড়ালটি জার্মানি থেকে পুরোপুরি উধাও হয়৷ মাত্র বছর বিশেক আগে লিনক্সরা পূর্ব ইউরোপ থেকে আবার জার্মানিতে আসতে শুরু করে, ফলে আজ জার্মানিতে নতুন করে লিনক্সদের দেখা যাচ্ছে৷ জার্মানির বনেজঙ্গলে লিনক্সদের সংখ্যা কতো আর তারা কীভাবে থাকে, তা নিয়ে গবেষণা চলেছে৷
বন বাঁচাতে বনবিড়াল
বাভেরিয়ার অরণ্য হলো মধ্য ইউরোপের বৃহত্তম বনাঞ্চল৷ লিনক্স নামের শিকারি জীবটি এখানে তৃণভোজীদের সংখ্যা সীমিত রাখতে সাহায্য করে৷ লিনক্সরা হরিণ শিকার করে, ফলে হরিণের দল গাছের কচি চারা খেয়ে ফেলে জঙ্গলের ক্ষতি করতে পারে না৷ শিকার আর শিকারিদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় না থাকলে দীর্ঘমেয়াদে জঙ্গল নিশ্চিহ্ন হবে – যে কারণে রেঞ্জারদের লিনক্স – এবং হরিণদের সংখ্যা সঠিকভাবে যাচাই করতে হবে; দেখতে হবে, বনবিড়ালরা যথেষ্ট পরিমাণে হরিণ শিকার করছে কিনা, নাকি মানুষ শিকারিদের আরো কিছু হরিণ শিকার করা প্রয়োজন৷ লিনক্সদের ওপর নজর রাখার জন্য যে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, তার নাম স্পাই-টেক: বনবিড়ালের গলায় জিপিএস কলার বেঁধে দিলেই হল৷
জিপিএস-এর তথ্য অনুযায়ী গভীর জঙ্গলেও লিনক্সদের চলাফেরার হদিশ রাখা সম্ভব৷ বন্যপশু জীববিজ্ঞানী মার্কো হয়রিশ জানালেন, ‘‘কলারে যে ট্রান্সমিটার আছে, তা জিপিএস অনুযায়ী লিনক্সটির অবস্থান এসএমএস-এর মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দেয়৷ এ থেকে আমরা জন্তুটির চলাফেরা, সে কোথায় থাকে বা না থাকে, কী খায় বা না খায়, এ সব তথ্য জানতে পারি৷'' কলারের ট্রান্সমিটার থেকে পাঠানো ডিজিটাল তথ্য থেকে দেখা গেছে যে, লিনক্সটি প্রায় প্যারিসের মতো একটা বড় এলাকা জুড়ে শিকার করে থাকে৷
শুধু বনবিড়ালদেরই নয়, হরিণদের গলাতেও ট্রান্সমিটার ঝোলানো আছে, যাতে আন্দাজ করা যায়, শিকার আর শিকারির ঠিক কোথায় মোলাকাত হয় আর তাতে বনবিড়ালের পেট ভরে কিনা! কোনো হরিণের গলায় বাঁধা জিপিএস ট্রান্সমিটার যদি বার-বার একই জায়গা থেকে সংকেত পাঠাতে থাকে, তবে তার অর্থ: লিনক্সের শিকার সফল হয়েছে৷ দিক-নির্দেশনার অ্যান্টেনা আর জিপিএস নিয়ে অকুস্থলে দৌড়লেন রেঞ্জাররা৷
শিকার ও শিকারি
মৃত হরিণটিকে খুঁজে পেতেও বেশি সময় লাগল না৷ মার্কো হয়রিশ পরীক্ষা করে দেখে বললেন, ‘‘বেশ একটু ফুলে উঠেছে৷ বেশ কিছুক্ষণ ধরে এখানে পড়ে রয়েছে বোধহয়৷'' কী ঘটেছে, তার চিহ্ন সর্বত্র৷ একটি লিনক্স হরিণটিকে মেরেছে, কিন্তু খাবার সময় সম্ভবত কোনো ব্যাঘাত ঘটে থাকবে৷ বনবিড়ালটি খুব সম্ভবত আবার শিকারের কাছে ফিরবে৷ ঠিক সেই মুহূর্তটিকে ধরে রাখার জন্য গবেষকরা আরেকটি প্রযুক্তির আশ্রয় নিয়েছেন৷ ইনফ্রা-রেড সেন্সর লাগানো ক্যামেরাটি অন্ধকারেও সামান্যতম নড়াচড়া ঘটলেই শাটার টিপে দেয়৷
গবেষকরা যতক্ষণ কাছাকাছি আছেন, ততক্ষণ লিনক্স শিকারের ধারে-কাছেও আসবে না৷ বনবিড়ালদের ইন্দ্রিয় মানুষের চেয়ে অনেক বেশি তীক্ষ্ণ; ওরা অনেক বেশি ভালো দেখে ও শোনে৷ কিন্তু গভীর জঙ্গলেও লিনক্সরা ক্যামেরা ট্র্যাপে ধরা পড়ে৷ এছাড়া গবেষকরা প্রতিটি লিনক্সকে শনাক্ত করতে সক্ষম৷ মার্কো হয়রিশ বললেন, ‘‘লিনক্সদের ক্ষেত্রে সুবিধে হলো এই যে, ওদের চামড়ায় একটা বিশেষ নকশা থাকে৷ একটা লিনক্সের দু'পাশ থেকে তোলা ছবি থাকলে, তাকে দ্ব্যর্থহীনভাবে শনাক্ত করা যায়, বলা চলে: এটা ঠিক ঐ বনবিড়াল!''
জঙ্গল ‘স্ক্যান'
লিনক্সকে নিয়ে সব মাতামাতি সত্ত্বেও জঙ্গলের অন্য বাসিন্দাদেরও ভুললে চলবে না৷ লিনক্সটির শিকারের পরিধির পূর্ণচিত্র পাবার জন্য বিমান থেকে গোটা জঙ্গল ‘স্ক্যান' করে দেখা হয়৷ মানুষের চোখ যেখানে শুধু গাছের চূড়া দেখে, থার্মোসেন্সিটিভ ক্যামেরা সেখানে মাটিতে উষ্ণরক্তের জীবদের উপস্থিতির সন্ধান করতে পারে৷ এভাবে এখানে যে সব জীবজন্তুর বাস, তাদের সংখ্যা আন্দাজ করা চলে৷
স্পাই-টেক নামের প্রযুক্তির ফলেই লিনক্সের মতো একটি সাবধানী পশুর হদিশ পাওয়া ও হদিশ রাখা সম্ভব হয়েছে৷ দেখা যাক, ভবিষ্যতে প্রযুক্তি আমাদের আর কী দেখায় ও শেখায়৷