বদলালো বিচারক অপসারণ ক্ষমতা
৩ জুলাই ২০১৭স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান লেখা হয়েছিল ১৯৭২ সালে৷ সেই সংবিধানে সংসদের হাতে ছিল বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা৷ সংবিধানের ৯৬ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদের ভোটে সমর্থিত প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ করা যাবে৷ আর ৯৬ (৩) অনুচ্ছেদে বলা ছিল, অপসারণের প্রস্তাব-সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে৷
এ বিষয়ে সংবিধানে দ্বিতীয় পরিবর্তনটি আসে ১৯৭৫ সালে৷ চতুর্থ সংশোধনীতে ৯৬ (২) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সরাসরি রাষ্ট্রপতির হাতে দিয়ে দেওয়া হয়৷ বিলুপ্ত করা হয় ৯৬ (৩) অনুচ্ছেদটি৷
দু'বছরের মাথায় আবারো নিয়ম পরিবর্তন করা হয়৷ এবার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এক সামরিক আদেশে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে দেয়া হয়৷ পরে ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে নিয়মটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷
তিন দশক পর পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন আপীল বিভাগ৷ তবে অনুমোদন দেয়া হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে৷ এই রায়ের পর ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাহাত্তরের সংবিধানের অনেক কিছুই ফেরত আনা হয়৷ কিন্তু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বাদ পড়েনি৷
তবে ২০১৪ সালে ষোড়শ সংশোধনীতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বাদ দিয়ে বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৬ (২) ও (৩) অনুচ্ছেদ দু'টি ফিরিয়ে আনা হয়৷ ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এ সংশোধনী আনা হয়, যেখানে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা আবারো ফিরে পায় সংসদ৷
সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ঐ বছরের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ন'জন আইনজীবী৷ প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর রুল দেয়৷ রুলে ওই সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়৷
এরপর সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে হাইকোর্ট ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়৷ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ৷ গত ১ জুন শুনানি শেষে সর্বোচ্চ আদালত মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে৷ আপীল বিভাগও শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে৷
এর আগে গেল ৭ মার্চ আপিল বিভাগ শুনানিতে জ্যেষ্ঠ ১২ আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দেন, যাঁদের মধ্যে ১০ জন আদালতে মতামত উপস্থাপন করেন৷ এঁদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, আবদুল ওয়াদুদ ভুইয়া, ফিদা এম কামাল, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, এ এফ হাসান আরিফ, এ জে মোহাম্মদ আলী ও এম আই ফারুকী ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে মত দেন৷ অপর অ্যামিকাস কিউরি আজমালুল হোসেন কিউসি সংশোধনীর পক্ষে মত দেন৷ অপর দু'জন মত উপস্থাপন করেননি৷
অ্যামিকাস কিউরিদের অন্যতম সদস্য ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে কথা বলে ডয়চে ভেলে৷ তিনি এই রায়কে ‘ঐতিহাসিক' বলে উল্লেখ করেছেন৷ নেদারল্যান্ড থেকে টেলিফোনে তিনি বলেন, ‘‘এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ অবদান৷'' বাহাত্তরের সংবিধানে তাহলে কেন এই বিধান রাখা হয়েছিল সে প্রশ্নের জবাবে এই অন্যতম সংবিধান প্রণেতা বলেন, ‘‘সংসদে এমন দলীয়করণ হবে সেটি তখন বোঝা যায়নি৷ স্বাধীনতার পর ৪৬ বছরের অভিজ্ঞতা তো তখন ছিল না৷'' সেই অভিজ্ঞতা থাকলে বিচারকের বিচার করার ভার সংসদ সদস্যদের ওপর দেয়া হত না বলে মনে করেন তিনি৷ সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের প্রসঙ্গে টেনে তিনি বলেন, এই অনুচ্ছেদের কারণে, কোন সংসদ সদস্য দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে মত দিতে পারেন না৷ ‘‘সংসদ সদস্যরা তো আদিষ্ট হয়ে বিচারকের বিচার করতে পারেন না৷ এটি সংবিধানের মৌলিক নীতির পরিপন্থি৷''
যে আদর্শিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা ড. কামাল হোসেন বলছেন, যেটির কথা মাথায় রেখে বাহাত্তরের সংবিধান করা হয়েছে, সে অনুযায়ী যদি সংসদ সদস্যদের দলের বাইরে গিয়ে মতামত দেয়ার সুযোগ থাকত, তাহলে কি বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে রাখা ঠিক হত? ড. কামাল হোসেন এরপরও এই ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়া সমর্থন করেন না৷ ‘‘এটি নিয়ে আদর্শ গণতান্ত্রিক দেশ ব্রিটেনে কথা হচ্ছে৷ ভারতে এতদিন ধরে তারা গণতান্ত্রিক চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে সেখানেও বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে৷ বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে রাখা ঠিক হবে না৷ তাহলে স্বাধীনভাবে বিচার বিভাগ কাজ করতে পারবে না৷'' বলেন তিনি৷
তবে সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক৷ ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, কোনো দেশেই এই ব্যবস্থা চালু নেই৷ ‘‘যেসব দেশে দুই আড়াইশ' বছর ধরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চর্চা হচ্ছে সেসব দেশেও এই ব্যবস্থা চালু আছে৷ সেখানে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করছে৷ কোনো সমসা হয়নি৷ আমাদের দেশেও এই ব্যবস্থা চালু থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হতো না৷'' এ বিষয়ে এখন মন্ত্রণালয় বা সরকারের পদক্ষেপ কী হবে জানতে চাইলে তিনি জানান, রায় ঘোষণার অংশটুকুই এখন পর্যন্ত জানা গেছে৷ পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পেলে রিভিউ পিটিশন বা অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হবে৷