বারুদের স্তূপে পশ্চিমবঙ্গ, পুলিশ কতটা তৎপর?
৩১ মার্চ ২০২২পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতিকে ঘিরে সন্ত্রাস কোনো নতুন ব্যাপার নয়। যত্রতত্র বোমা মজুতের ফলে কতবার ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে! পুরুলিয়া মাদ্রাসা থেকে পিংলা বিস্ফোরণ, কালিয়াচক, ধূলাচক, খাগড়াগড়, নৈহাটি, এমনকি বর্ধমানের রসিকপুরের সেই ঘটনাটার কথা মনে পড়ে? রসিকপুরে হাঁড়িতে রাখা গোল বস্তুটিকে বল ভেবে খেলতে গিয়ে মৃত্যু হয় শিশুর। এক সময় এমন ঘটনার প্রতিবাদেই গান লিখেছিলেন কবীর সুমন- "বাহবা সাবাস বড়দের দল এই তো চাই / ছোটরা খেলবে আসুন আমরা বোমা বানাই।” যদিও কবীর সুমন এখন বোমা সন্ত্রাস গণহত্যা কোনো কিছু নিয়েই আর সরব হন না।
চলতি মাসে একের পর এক ঘটনায় এ নিয়ে ফের শোরগোল উঠেছে। সবচেয়ে বড় ঘটনা অবশ্যই রামপুরহাটের বগটুই গণহত্যা। তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে উপপ্রধান খুনের পর পুড়িয়ে মারা হয়েছে ১০ জনকে। বীরভূমের গ্রামে ঘটনার দিন মুহুর্মুহু বোমা পড়েছে। তার ঠিক আগে পানিহাটি ও ঝালদায় দুই কাউন্সিলর আততায়ীর শিকার হন। পানিহাটির কাউন্সিলরকে গুলি করে মারার ভিডিও ভাইরাল হয়। তারপর রামপুরহাটের ঘটনা নিয়ে যখন উত্তাল রাজ্য, তখন মুখ্যমন্ত্রী ওই গ্রামে দাঁড়িয়ে পুলিশকে নির্দেশ দেন, অবিলম্বে বোমা-গুলি-আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করতে হবে।
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ পাওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ-প্রশাসন। জেলায় জেলায় পুলিশি তল্লাশি গতি পেয়েছে। বিভিন্ন থানা এলাকা থেকে পাওয়া যাচ্ছে বোমা-বারুদ-আগ্নেয়াস্ত্র। পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুরে একটি বালতি থেকে শ'খানেক বোমা মেলে। বীরভূমের মাড়গ্রাম, লাভপুর, দুবরাজপুর, মল্লারপুর থেকে চারদিনে পাওয়া গিয়েছে ৪০০-র বেশি তাজা বোমা, ৩০ কেজির বেশি বোমার মশলা। মুর্শিদাবাদে গুলি, আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমা উদ্ধার হয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট ও বর্ধমানের খাগড়াগড় মোড় থেকে আগ্নেয়াস্ত্র-সহ দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সব অভিযানের মধ্যেই আবার ঘটেছে দুর্ঘটনা। মঙ্গলবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার
বাসন্তীতে একটি বাড়িতে জোরালো বিস্ফোরণ হয়। তাতে আহত একজনের মৃত্যু হয়েছে। পাশাপাশি বারুইপুর, ক্যানিং থেকেও তাজা বোমা উদ্ধার করা হয়েছে। এইসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধীরা বলছে, বাংলা রয়েছে বারুদের স্তূপের উপর।
যে বীরভূম জেলা এখন আলোচনার কেন্দ্রে, সেখানকার সিপিএম নেতা, প্রাক্তন সাংসদ রামচন্দ্র ডোম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "পুরোটাই নাটক। মুখ্যমন্ত্রী জানেন অস্ত্র না থাকলে তাঁরা ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবেন না। রামপুরহাটের মতো বড় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তিনি বাধ্য হয়েছেন ব্যবস্থা নিতে। আসলে এটা আই-ওয়াশ।” একই সুরে কংগ্রেসের ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট চঞ্চল চট্টোপাধ্যায় বলেন, "বগটুই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গোটা বীরভূম উড়ে যেতে পারে। বীরভূমে যা বোমা মজুত আছে, তাতে যে কোনো দেশ উড়ে যেতে পারে। আমরা বারবার অভিযোগ করেছি, কিন্তু পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।”
কেন পুলিশ কাজ করেনি? প্রাক্তন পুলিশকর্তা সন্ধি মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এই সমস্ত ঘটনা প্রমাণ করে, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখায় মতো অবস্থায় নেই এই রাজ্যের পুলিশ। স্থানীয় পুলিশ আধিকারিক তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তার কথা শুনছেন না। এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে যে এলাকার শাসক দলের নেতাদের হাতে পুলিশের ভালো-মন্দের ভার। এতে পুলিশের কাঠামোটাই প্রশ্নের মুখে পড়েছে।”
রামপুরহাট গণহত্যার পর রাজ্যের প্রধান বিরোধী বিজেপিকে প্রতিবাদে বেশ তৎপর দেখাচ্ছে রাজ্যপালের কাছে দরবার থেকে মিছিল, সবেতেই বামেদের টেক্কা দিয়েছে গেরুয়া শিবির। বিজেপির জেলা সভাপতি ধ্রুব সাহার বক্তব্য, "বীরভূমে আমরা বারুদের স্তূপের উপর দাঁড়িয়ে আছি। পাড়ায়-পাড়ায়, ঘরে-ঘরে মজুত বোমা পাওয়া যাচ্ছে। যাদের বাড়ি থেকে বোমা পাওয়া যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ পদক্ষেপ করছে না। যেহেতু এ সব তৃণমূলের হার্মাদ আর লেঠেল বাহিনীর বোমা।”
শাসক দল অবশ্য বিরোধীদের অভিযোগ খারিজ করেছে। তাদের পাল্টা বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে পুলিশের তৎপরতায় বোমা, গুলি উদ্ধার হচ্ছে। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে কার্যকরী ভূমিকা নিচ্ছে প্রশাসন। বিরোধীরাই মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করছে, ঘোলা জলে মাছ ধরতে চাইছে। বীরভূমের তৃণমূল জেলা সহ সভাপতি অভিজিৎ সিংহ বলেন, "মুখ্যমন্ত্রী উন্নয়নের বার্তা নিয়ে চলেছেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, অসামাজিক লোক খুঁজে বার করে তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার। এ রকম মুখ্যমন্ত্রী কোথায় আছেন, যিনি বলেন কড়া সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা? তিনি বলেছেন, তাই পুলিশ পদক্ষেপ নিচ্ছে।”
এমন রাজনৈতিক চাপানউতোর পশ্চিমবঙ্গে সব বিষয়েই হয়। কিন্তু সমস্যাটা ঠিক কোথায়? জেলায় জেলায় কীভাবে চলছে বারুদের কারখানা? একেবারে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে দেখছেন সাবেক আইপিএস আধিকারিক নজরুল ইসলাম। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "প্রশাসন জানে যে শাসক দলের বিভিন্ন গোষ্ঠীর হাতে অস্ত্র রয়েছে। রামপুরহাটে সেটা এমন ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যে তাতে শাসকই অস্বস্তিতে পড়েছে। অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। ফলে বাকি যে অস্ত্র শাসকের মদদপুষ্ট সমাজবিরোধীদের হাতে রয়েছে, সেগুলি উদ্ধারে তৎপর হয়েছে পুলিশ। শাসকদলের আশঙ্কা, যদি এই অস্ত্র ব্যবহারের ফলে তাদের আরও ক্ষতির মুখে পড়তে হয়!”
এক্ষেত্রে পুলিশি ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন রাজ্যের সাবেক পুলিশ কর্তা নজরুল ইসলাম। তার বক্তব্য, "মুখ্যমন্ত্রীকে এ ধরনের নির্দেশ দিতে হবে কেন? বেআইনি অস্ত্র থাকলে তাকে গ্রেফতার করে সাজা দিতে হবে। পুলিশ এতদিন তা করেনি কেন? আসলে পুলিশকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। রামপুরহাটের ঘটনায় তাই আইসি, এসডিপিও-র ভূমিকা নিয়ে তদন্ত হচ্ছে।”