বার্লিনালে ও বাংলাদেশ
১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯চাকরির সুবাদে দুই দফা মিলেয়ে বছরখানেক হয়েছে জার্মানির বন শহরে বসবাস৷ ভ্রমণপাগল হওয়ায় এর মধ্যেই আশেপাশের বেশকিছু দেশও ঘুরে ফেলা হয়েছে৷ কিন্তু ‘মক্কার মানুষ হজ পায় না' প্রবাদের সার্থক বাস্তবায়ন ঘটিয়ে বার্লিন যাওয়া হয়নি একবারও৷
ফলে ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগের হয়ে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব বার্লিনালের ৬৯তম আসর কভার করতে যাওয়ার সৌভাগ্য হওয়ায় বেশ আপ্লুতই হয়েছিলাম৷
টেগেল বিমানবন্দরে নামতেই চোখে পড়লো একগাদা তরুণ-তরুণীর ভিড়৷ সবার হাতে বার্লিনালের কাগজ৷ বিভিন্ন দেশ থেকে যাঁরা আসছেন উৎসবে যোগ দিতে, সিনেমা দেখতে, সবাইকে সহায়তা করার জন্য স্টাড্ট বা শহর কর্তৃপক্ষ বেশকিছু গাইড নিয়োগ দিয়েছেন৷ তাঁদের একজন এগিয়ে এসে নিজে থেকেই আমাদের দেখিয়ে দিলেন, কিভাবে কোন টিকেট কিনলে আমাদের তিন দিন যাতায়াতের সুবিধা হবে৷
যথারীতি, এবারও পটসডামার প্লাৎসের চারপাশে অনেকগুলো ভেন্যু জুড়ে একই সাথে চলছে মূল প্রতিযোগিতা, বার্লিনালে ট্যালেন্টস, কো-প্রোডাকশন মার্কেট৷ গ্র্যান্ড হায়াত হোটেল থেকে প্রেস কার্ড জোগাড় করেই শুরু দৌড়ঝাঁপ৷ সঙ্গে ডয়চে ভেলের হিন্দি বিভাগ থেকে সহকর্মী অশোক কুমারও ছিলেন, ফলে দুজন মিলে বেশকিছু কাজ সহজে করে ফেলার সুযোগও ছিল৷
মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ থেকে উৎসবে যোগ দিতে আসা তরুণদের সঙ্গে সিনেমা নিয়ে কথা বলা৷ অশোকের সঙ্গে থাকায় বলিউডের এখনকার চালচিত্র সম্পর্কেও ধারণা হলো খানিকটা৷
ভৌগোলিক অবস্থানের হিসেবে, ভারত সাংস্কৃতিকভাবে বলিউডের মাধ্যমে যোজন যোজন এগিয়ে গিয়েছে৷ এখন বিশ্বের যে-কোনো প্রান্তে ভারত মানেই বলিউড, ভারত মানেই শাহরুখ খান৷ কিন্তু এই সাংস্কৃতিক জয়যাত্রার পেছনে অর্থবিত্তের সংযোগ যেমন রয়েছে, রয়েছে পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতাও৷
নিজেদের কথা, সংস্কৃতি তুলে ধরতে ভারত নিজেই একটা প্যাভিলিয়ন দিয়েছে৷ সেখানে বলিউডের চলচ্চিত্রের নানা দিক বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ হলিউড রিপোর্টার ম্যাগাজিনের একটি কপি হাতে নিয়েই চমকে যেতে হলো৷ কভার পৃষ্ঠাতে ভারতীয় সরকারের বিজ্ঞাপন৷ অন্য সব চলচ্চিত্রের মতো বার্লিনালেতেও নানাভাবে ভারতীয় সিনেমার প্রোফাইলিং খুব ভালোভাবেই হচ্ছে৷
<iframe src="https://www.facebook.com/plugins/video.php?href=https%3A%2F%2Fwww.facebook.com%2Fdw.bengali%2Fvideos%2F441756906362996%2F&show_text=0&width=560" width="560" height="315" style="border:none;overflow:hidden" scrolling="no" frameborder="0" allowTransparency="true" allowFullScreen="true"></iframe>
অশোককে চিত্রধারণে সহায়তা করতে গিয়ে বেশ কয়েকজন ভারতীয় চলচ্চিত্র সমালোচক ও নির্মাতার সঙ্গেও কথা হলো৷ বলিউডের প্রায় সব সাড়া জাগানো চলচ্চিত্রই মুক্তির কিছুদিনের মধ্যেই প্রদর্শিত হয় জার্মানিতে৷ এমনকি কোনো কোনো হিন্দি সিনেমার ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার ভারতের সাথে একই দিনে বার্লিনে হয় বলেও জানালেন তাঁরা৷
বাংলাদেশ যদিও এ তুলনায় বেশ পিছিয়ে আছে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপষকতা পেলে কি বাংলা চলচ্চিত্র আরো খানিকটা এগিয়ে যেতো? বার্লিনালে ট্যালেন্ট ক্যাম্পাসে আসা সিনেমাটোগ্রাফার বরকত হোসেন পলাশ অবশ্য মনে করছেন, রাষ্ট্রের তেমন সহায়তা ছাড়াই স্বাধীন ঘরানার চলচ্চিত্র অনেক এগিয়ে যাচ্ছে৷ তরুণরা নানা এক্সপেরিমেন্ট করছেন সিনেমা নিয়ে, যা বিশ্বজুড়ে প্রশংসিতও হচ্ছে৷
পলাশ মনে করেন, এখন যে তারুণ্যের জাগরণ চলছে, আগামী ৪-৫ বছরের মধ্যেই তার ফল দেখবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র৷ এখন শুধু বাংলাদেশের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে গ্লোবাল মার্কেটে বাংলাদেশকে ছড়িয়ে দেয়ার সময় হয়েছে বলেও মনে করেন এই তরুণ সিনেমাটোগ্রাফার৷
পলাশের সাথে একমত বার্লিনালে ট্যালেন্ট ক্যাম্পাসে আসা তরুণ নির্মাতা হুমায়রা বিলকিসও৷ তিনি বলছেন, স্থানীয় গল্পগুলোকে বৈশ্বিক দর্শকদের উপযোগী করে উপস্থাপনই তাঁর পছন্দের৷ হুমায়রা জানান, একেবারেই নিজের গল্প অন্য দেশ থেকে বার্লিনালেতে আসা চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের কাছে সমানভাবে প্রশংসিত হয়েছে৷ ফলে, সিনেমা কোথায় তৈরি হয়েছে, কে তৈরি করেছেন, তার চেয়ে বরং সিনেমার গল্প ও উপস্থাপনাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি৷
বাংলাদেশ থেকে আসা তরুণদের সাথে আড্ডার এক পর্যায়ে যোগ দেন দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপের দর্শকদের সামনে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করে চলা নির্মাতা শাহীন দিল রিয়াজ৷ বার্লিনে বাস করা আরো কয়েকজন শিক্ষার্থীও যোগ দেন চা-কফির এই আড্ডায়৷ বার্লিনালে পালাস্টের রেড কার্পেটের পাশে এক কফি শপে এটুকুই যেন এক টুকরো বাংলাদেশ৷
পুরো বার্লিন জুড়ে উড়ছে লাল রঙের ভল্লুকের ছবি আঁকা পতাকা-ফেস্টুন, ব্যানার৷ বিভিন্ন ভেন্যুতে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন মহাদেশ থেকে আসা চলচ্চিত্রের পোস্টার৷ বাংলাদেশ থেকে আসা তরুণদের সঙ্গে কথা বলে, আমিও এক বুক স্বপ্ন নিয়ে ফেরত এলাম৷ অচিরেই বাংলাদেশ বিশ্ব চলচ্চিত্রের মঞ্চে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করবে এঁদের হাত ধরেই৷ সে দিন বেশি দূরে নয়৷