বায়ুদূষণ, বিশ্বকাপ ক্রিকেট ও দিল্লির বিপজ্জনক অবস্থা
৩ নভেম্বর ২০২৩ম্যাচের আগের দিন সাংবাদিক সম্মেলন করতে এসে রোহিত এই বায়ুদূষণের প্রসঙ্গে বলেন, ''আদর্শ পৃথিবীতে এরকম অবস্থা হওয়ার কথা নয়। আমি নিশ্চিত যারা দায়িত্বে আছেন, তারা এরকম অবস্থা যাতে না হয়, তার জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছেন। সবাই জানেন এটা আদর্শ পরিস্থিতি নয়।''
রোহিত খোলাখুলি বলেছেন, ''ক্রিকেটের বাইরে কোনো বিষয়ে বলতে হলে তিনি এই প্রসঙ্গেই কথা বলতে ভালোবাসেন। কারণ, এর সঙ্গে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ জড়িত।''
ইংল্যান্ডের অনেক প্লেয়ার তো বায়ুদূষণের মোকাবিলা করতে ইনহেলার নিচ্ছেন বলে বর্তাসংস্থা পিটিআই জানিয়েছে। মুম্বইয়ে খেলার পর জো রুট বলেছিলেন, তার দমবন্ধ হয়ে আসছিল, তবে এটা বায়ুদূষণের জন্য কিনা, তা তিনি জানেন না। এখন আমেদাবাদে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে খেলার আগেও বায়ুদূষণের হাত থেকে বাঁচতে তারা ইনহেলার ব্যবহার করছেন।
মুম্বইয়ের পরিস্থিতি দেখেই রোহিত শর্মা, জো রুটদের এই অবস্থা। তাহলে তারা দিল্লি এলে কী বলতেন! শুক্রবারের হিসাব, মুম্বইতে একিউআই হলো ১৬৮। আর দিল্লিতে ৪১৯। একিউআই মানে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স। ১৬৮ একিউআই মানে অস্বাস্থ্যকর অবস্থা। আর সেটা যখন চারশ ছাড়িয়ে যায়, তখন তা মারাত্মক বিপজ্জনক অবস্থা হয়ে যায়।
এখন রাজধানীর পরিস্থিতি মারাত্মক বিপজ্জনক। পুরো দিল্লি ও রাষ্ট্রীয় রাজধানী এলাকায় (যার মধ্যে নয়ডা, গাজিয়াবাদ, গুরুগ্রাম, ফরিদাবাদের মতো জায়গাও পড়ে) পরিস্থিতিটা একইরকম। ১৬৮ একিউআই দেখে আতঙ্কিত হয়ে যাচ্ছেন রোহিত শর্মা, ইনহেলার নিতে হচ্ছে ইংল্য়ান্ডের ক্রিকেটারদের, তাহলে দিল্লিবাসীর অবস্থাটা ভাবুন। অধিকাংশ দিল্লিবাসীর হয় সর্দি-কাশি, জ্বর, ফুসফুস আক্রান্ত বা গলা খারাপ। চোখ জ্বালা করছে।
শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টি৩ টার্মিনাসে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা একিউআই ছিল ৪৭৩, আরকে পুরমে ৪৮৬, জাহাঙ্গিরপুরিতে ৪৯১, লোদী গার্ডেনে ৪৩৮, দ্বারকায় ৪৮০, ওখলায় ৪৭২, পুসায় পাঁচশর বেশি।
ফুসফুসের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পার্থপ্রতিম বোস ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''গত সাত দিনে আমার কাছে শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যা সত্তর শতাংশ বেড়ে গেছে। যারা দুই বছর ধরে ঠিক ছিলেন, তারা আসছেন। আর যারা আগে করোনায় ভালোরকম আক্রান্ত হয়েছিলেন তারাও আসছেন। যাদের আগে সর্দি-কাশি অতটা হত না, তারাও আসছেন।'' তিনি বলেছেন, ''বায়ুদূষণ যে জায়গায় পৌঁছেছে, সেখানে বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে বলে ক্ষতি হচ্ছে, বয়স্করা মর্নিং ওয়াকে গেলে ক্ষতি হচ্ছে, এমনকী অফিসে যাওয়া-আসার সময়ও ক্ষতি হচ্ছে। ঘরের ভিতরেও দূষণের অবস্থা মারাত্মক।''
অ্যাপলো হাসপাতালের চিকিৎসক নিখিল মোদী বার্তা সংস্থা এএনআইকে বলেছেন, তাদের হাসপাতালে শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে।
দুই চিকিৎসকের পরামর্শ, মানুষ যেন এখন খুব দরকার না হলে বাড়ির বাইরে না যান।
তবে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের হোটেলে থাকার উপায় নেই। তাদের এই দূষণের মধ্যেই খেলতে হবে। দিল্লিতে আগামী ৬ নভেম্বর বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে এবং মুম্বইতে ৭ নভেম্বর অস্ট্রেলিয়া ও আফগানিস্তানের মধ্যে ম্যাচ।
এই দুই ম্যাচ নিয়ে বিসিসিআই কথা বলেছে আইসিসি-র সঙ্গে। বিসিসিআইয়ের সচিব জয় শাহ জানিয়েছেন, ''আমরা আইসিসি-কে জানিয়ে দিয়েছি, দিল্লি ও মুম্বইয়ের ম্যাচে কোনো বাজি ফাটানো হবে না। এমন কিছু করা হবে না, যা থেকে বায়ুদূষণের পরিমাণ বাড়ে।'' বাজি না হয় ফাটানো হলো না, কিন্তু এই আবহাওয়া তো এত তাড়াতাড়ি ঠিক হচ্ছে না। তাই দিল্লিবাসী কীরকমভাবে বেঁচে আছে, মুম্বইতে দূষণের বাড়বাড়ন্ত কীরকম তা ভালোকরেই টের পাবেন বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া ও আফগানিস্তানের ক্রিকেটাররা।
দিল্লির পরিস্থিতিটা কীরকম? পার্থপ্রতিম বোস বলেছেন, ''এবার বায়ুদূষণ আরো মারাত্মক আকার নিয়েছে আবহাওয়ার পরিবর্তন,ও বিশ্বের একাধিক জায়গায় যুদ্ধের প্রভাবে। এছাড়া প্রতিবার যে কারণগুলো থাকে ,সেটা তো আছেই। এবার হাওয়া এতটাই ভারী হয়ে গেছে যে দূষিত বস্তুগুলো সরাসরি আমাদের ফুসফুসে ঢুকে আমাদের শরীর খারাপ করে দিচ্ছে।''
এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানিয়েছেন, ''আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে বাতাসে ভেজা ভাব বেশি রয়েছে। ফসিল ফুয়েল পুড়লে সালফার ডাই অক্সাইড ও নাইট্রস অক্সাইড বের হয়। জলের সঙ্গে মিশে তা সালফিউরিক অ্যাসিড ও নাইট্রিক অ্যাসিডে পরিণত হয়। ফলে একরকম অ্যাসিড রেনের মতো অবস্থা হচ্ছে। এটা খুবই ক্ষতিকর। সবমিলিয়ে সর্দি-কাশি, গলা খারাপ, জ্বর ও শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।''
এরসঙ্গে একটা ছোট সংখ্যাতত্ত্ব দেয়া যাক। ২০২২ সালের দিল্লির ইকনমিক সার্ভের রিপোর্ট অনুয়াযী, দিল্লিতে প্রায় ৩৪ লাখ গাড়ি ও জিপ আছে। ৮২ লাখ ৩৯ হাজার দুই চাকার যান আছে। এক লাখ ১৫ হাজার অটোরিক্স ও এক লাখ ১২ হাজার ট্যাক্সি আছে। ফলে গাড়ি ও দ্বিচক্রযান থেকে বার হওয়া দূষিত পদার্থ দিল্লির বাতাসে গিয়ে মেশে। সেই সঙ্গে দিল্লিতে যে কোনো এলাকায় একবার ঘুরলেই চোখে পড়বে নির্মাণকাজ চলছে। হয় বাড়ি ভাঙা হচ্ছে বা নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে। দুইটি কাজের জন্য প্রচুর ধুলো বাতাসে মেশে। তাই দিল্লির বাতাসে ধুলোর পরিমাণ অনেক বেশি।
কী করছে সরকার
আপ নেতা অনুপ ঠাকুর ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ''সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, স্কুলগুলি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। ডিজেল ট্রাক দিল্লিতে ঢুকতে দেয়া হবে না। যে সব জায়গায় দূষণ চারশ চাড়িয়েছে, সেখানে নির্মাণকাজ বন্ধ রাখতে হবে।''
তিনি জানিয়েছেন, ''গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার কথাও ভাবা হচ্ছে। আপাতত সব গাড়িকে ট্রাফিক সিগন্যাল লাল হলে স্টার্ট বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। দিল্লি সরকার প্রতিদিন বৈঠক করছে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। আর পুরসভার তরফ থেকে রাস্তায় গাছের পাতায় জল স্প্রে করা হচ্ছে যাতে ধুলো না ওড়ে।''
কী করতে হবে?
পার্থপ্রতিম বোসের মতে, ''আবহাওয়ার পরিবর্তনের বিষয়টি আমাদের হাতে নেই। কিন্তু যে কাজ করে মানুষ এই বিপদ ডেকে আনছে, তা বন্ধ করতে হবে। খড় পোড়ানো থামাতেই হবে, একটাও বাজি ফাটানো যাবে না, এখন গাড়ির ব্যবহার হয় বন্ধ করতে হবে, না হলে খুবই কম করতে হবে। স্কুলের সময় বদল করতে হবে।''
তিনি জানিয়েছেন, ''প্রত্যেককে স্টিম নিতে হবে, শ্বাসের ব্যায়াম করতে হবে, ন্যাসাল ওয়াশ করতে হবে। সম্ভব হলে ফ্লু ও নিউমোনিয়া ভ্যাকসিন নিতে হবে। সকালে হাঁটতে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। দুপুরের দিকে হঁটতে যাওয়া উচিত। ভিটামিন সি ও ডি যাতে শরীরে বেশি যায় তা খেয়াল রাখতে হবে।''
পরিস্থিতি এমনই দিল্লিতে অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে যদি প্লেয়ারদের বিরতিতে স্টিম নিতে, ন্যাসাল ওয়াশ করতে দেখা যায়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।