‘আন্দোলনে রাজনৈতিক সমর্থন লাগবে’
২১ নভেম্বর ২০১৬বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন ড: মামুন৷
ডয়চে ভেলে: তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমরা লক্ষ্য করি৷ বাংলাদেশে এই প্রবণতা আরো বেশি৷ এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
অধ্যাপক মুনতাসির মামুন: উত্তরণের উপায় হচ্ছে ‘গুড গভর্নমেন্ট'৷ আমাদের মতো দেশে যেখানে সামরিক প্রভাব ছিল, এখনও আছে, সেখানে সিভিল গভর্নমেন্টের পক্ষে কাজ করে, (বিচারহীনতার সংস্কৃতি) পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল হয়ে যায়৷ এছাড়া নাগরিক হিসেবেও আমরা সচেতন নই৷ সরকারের যে বিভাগগুলো আছে সেখানেও কিন্তু আইনের লংঘন হলে প্রতিকারের জন্য এগিয়ে আসেনি কেউ৷ আমাদের যে ঘটনাটা ঘটে গেছে নাসিরনগরে, সেটার জন্য লড়তে দু'একজন দাঁড়াচ্ছে৷ ফলে আমাদের জন্য কাজগুলো কঠিন হয়ে যাচ্ছে৷
আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, যুদ্ধপরাধীদের বিচারসহ বেশ কিছু বড় মামলার বিচার হচ্ছে বা হয়েছে৷ সাধারণ মানুষের মামলার ক্ষেত্রে এটা নিশ্চিত করা যায়নি৷ এটা কিভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব?
আমরা যেটা বলি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে উত্তরণ হচ্ছে৷ যে দেশে বঙ্গবন্ধু খুন হয়েছিলেন, জাতীয় চার নেতা খুন হয়েছিলেন, সেখানে এই হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার হয়নি, উল্টো খুনিরা পুরস্কৃত হয়েছিলেন৷ যখন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হলো, জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার হলো তখন, কিন্তু আমরা বলছি বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমরা বের হচ্ছি৷ একটা কথা মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার ৪০ বছর পর জনগণের চাপ ছিল এবং শেখ হাসিনার নিজেরও একটা ইচ্ছে ছিল বলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্ভব হয়েছে৷ বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার ক্ষেত্রেও তাই৷ কিন্তু দৈনন্দিন যে মানবাধিকার লংঘন হয় সেটির বিচার কীভাবে হবে৷ আমরা সেখানে পৌঁছাতে পারছি না৷ প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যে অবিচার হয় সেখানে তাদের বদলি করা হয়, শাস্তি দেয়া হয় না৷ এটাও কিন্তু একটা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়ে গেছেষ৷ ফলে প্রক্রিয়াটি খুবই জটিল এবং সেটি কী হবে তা আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব না৷
সুশীল সমাজের এক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা আছে কী? আমরা দেখি সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও কোনো একটা পক্ষ নিয়েই কথা বলেন৷ তাঁদের ভূমিকা কি হতে পারে?
এক্ষেত্রে তাদের কোনো মনোযোগ আছে বলে আমি মনে করি না৷ অনেক সময় হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে কিছু ভূমিকা রাখে৷ আমার কাছে মনে হয় সেটাও যথেষ্ট না৷ আমরা যাঁদের সুশীল সমাজ বলি তাঁদের নিজেদের অনেক রকম এজেন্ডা আছে৷ এই এজেন্ডা বাস্তবায়নে তাঁরা মনোযোগী৷ আমার মনে হয়, জনগণকে সচেতন হতে হবে৷ তাদের মনে রাখতে হবে বিচার পাওয়া আমার সাংবিধানিক অধিকার৷ আর সরকারও বিচার সহায়তা কার্যক্রম গ্রহণ করেছে৷ এই বিষয়টিও সাধারণ মানুষ জানেন না৷ বিচার পাওয়া আমার অধিকার, কিছু হলে আমি বিচার চাইতে পারি এই বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে একটা ক্যাম্পেইন শুরু হতে পারে৷
বাংলাদেশে অপরাধ করলে টাকা দিয়ে পার পাওয়া যায় বলে একটা ধারণা আছে৷ রাজনৈতিক ব্যক্তিরা তো খুবই প্রভাবশালী৷ তাদের বিচারের আওতায় আনার উপায় আছে কী?
আমি কোনো সম্ভাবনা দেখি না৷ আপনি যে প্রশ্ন করলেন সেটা সঠিক নয়, এটা আমি বলব না৷ আমি লেখালেখি করি৷ এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কিছুই নেই৷ আমরা অসহায়৷ সমাজে এখন একটা বদল হচ্ছে৷ নতুন যে বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে সেটা অর্থ৷ অর্থ দিয়ে সব কেনা যায়৷ সেটা আমাদের নেই৷ আর থাকলেও কিনতে চাইব না৷ সেই অর্থের বিপরীতে একটা অবস্থান নেয়া খুবই কঠিন কাজ৷ এখন নাগরিক সমাজের কোনো প্রতিনিধি তৈরি হয় কিনা তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে৷ এই বাইরে আমাদের কিছু বলার নেই৷
বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হতে সরকারকে বাধ্য করতে জনগণ কি কোনো ভূমিকা রাখতে পারে?
হ্যাঁ পারে৷ কিন্তু একটা সমস্যা হচ্ছে জনগণ যদি কোনো দাবি নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তাহলে সরকারের তরফ থেকে বলবে, এটা নাগরিক দাবি না৷ এটা বিরোধীদের আন্দোলন৷ এখানে একটা বিভাজন তৈরি হয়ে গেছে৷ তাই আমি প্রথমেই বলেছি, সচেতনতা সৃষ্টি হতে পারে প্রাথমিক পদক্ষেপ৷ সরকারের যে সংস্থা আছে তারা যদি যারা বিচার পাচ্ছে না তাদের ব্যাপারে এগিয়ে আসে তাহলেও আমরা অনেকখানি এগিয়ে যেতে পারি৷ এছাড়া উত্তরণের পথ আমার জানা নেই৷ আমরা বলতেও পারব না৷ অনেক বড় বড় কথা বলা যাবে৷ কিন্তু তা করে কোনো লাভ নেই৷
জনগণকে সচেতন করার ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?
পরামর্শ কিছু না৷ আসলে পরামর্শ দিয়ে কোনো কাজ হবে না৷ নাগরিক সমাজের যাঁরা নেতৃত্ব দেন তাঁরা যদি সচেতনতা সৃষ্টিতে এগিয়ে আসেন এবং স্বতস্ফূর্তভাবে কাজ করেন, এজেন্ডা মনে করে, তাহলে একটা কাজ হতে পারে৷ এটাকে ওভাবে গ্রহণ না করলে কোনো কাজ হবে না৷
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কি কোন উপায় আদৌ আছে?
আসলে এ ব্যাপারে আমার কিছু জানা নেই৷ আমি কোনো ধারণা দিতে পারব না৷ পরিস্থিতি হতাশাজনক৷ প্রত্যেক দেশই এমন একটা সময় অতিক্রম করে৷ আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে৷ অর্থ দিয়ে সবসময় কেনা যাবে না, আবার কেনাও যেতে পারে৷ পাশ্চাত্যে আমরা দেখেছি, নৈতিকতা নিজের থেকেই চলে আসে, অথবা তারা মানতে বাধ্য হয়৷ সেটার জন্য একটা সময় আসবে৷ সেটার জন্য আমরা অপেক্ষা করতে পারি৷ অথবা ঐ ধরনের কোনো নাগরিকের জন্য আমরা অপেক্ষা করতে পারি, যিনি এই বিষয়ে গুরুত্ব দেবেন এবং কাজ করে যাবেন৷
বিচারহীনতার পাশাপাশি দায়মুক্তির একটা সংস্কৃতি আপনি খেয়াল করেছেন৷ এই সংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ আছে?
এটা একসঙ্গেই যুক্ত৷ এটা নিয়ে আলাদা কিছু করার বা ভাববার নেই৷ যারা যখন ক্ষমতায় থাকেন তারা এটা করবেন৷ এক্ষেত্রে আমরা কী করতে পারি? যারা চুপ করে থাকতে পারেন না তাদের মাঠে নামতে হবে৷ সেই কথাই তো বলছি৷ আমরা যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে কাজ করেছি ৪০ বছর ধরে৷ সেরকম আরো দু'জনকে ৪০ বছর থেকে কাজটা এগিয়ে নিতে হবে৷ এটা স্বতস্ফূর্তভাবে না হলে তো হবে না৷ একটা বিষয় বুঝতে হবে- সবকিছুর দায় দায়িত্ব যারা করে যাচ্ছে তাদের উপর বর্তানো ঠিক নয়৷ এতগুলো এজেন্ডা আমরা নিতে পারব না৷ আমরা এটাকে আমাদের জেনারেশনের দায় মনে করেছি সেজন্য আমরা জেল-জুলুম রিমাণ্ড নির্যাতন সহ্য করেছি, সাফল্যও পেয়েছি৷ কারণ জনগণকে আমরা নিয়ে আসতে পেরেছি৷ এরজন্য রাজনৈতিক সাপোর্ট দরকার৷ না হলে এটা হয় না৷ বিচারহীনতার সংস্কৃতি নিয়েও একইভাবে কাজ করতে হবে এবং এর জন্য রাজনৈতিক সাপোর্ট লাগবে৷ না হলে আমরা কোনো লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব না৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷