বিছানার চাদর ও বালিশের কাভার কিনতে জার্মানি যাচ্ছেন আইজিপি
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২অবশ্য এই ধরনের পণ্য বাংলাদেশেই তৈরি হয় এবং এখন অ্যামেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া ও ইউরোপসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে৷ জার্মানিতেও এসব পণ্যের বড় বাজার আছে৷
জার্মানির যে প্রতিষ্ঠান থেকে এসব আনা হবে তার গ্রহণযোগ্যতা ও মান যাচাই করতে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদের জার্মানি যাওয়ার কথা রয়েছে এই মাসেই৷ তার সঙ্গে আরো যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপ-সচিব মো. ফিরোজ উদ্দিন খালিফা এবং পুলিশ সদর দপ্তরের এসপি ও আইজিপির স্টাফ অফিসার মোহাম্মদ মাসুদ আলম৷ ওই চাদর ও বালিশের কাভার শিপমেন্টের আগেই তারা মান পরীক্ষা করবেন৷
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপ-সচিব মাহবুবুল আলম মজুমদারের সই করা চিঠিতে এই তথ্য জানা গেছে৷ তার কাছে টেলিফোনে ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘‘তাদের যাওয়ার জন্য আমি আদিষ্ট হয়ে চিঠি দিয়েছি৷ সিদ্ধান্ত হয়েছে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে৷ তারা ভিসা পেয়েছেন কী না, যাবেন কী না, সেই তথ্য আমার কাছে নাই৷’’
জার্মানিতে মোট নয় দিন অবস্থান করার কথা রয়েছে তাদের৷ ফেব্রুয়ারি মসের মধ্যেই সুবিধাজনক সময়ে তারা যাবেন বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে৷
পরররাষ্ট্র সচিবকে নোট ভারবাল (এক দেশকে আরেক দেশের আনুষ্ঠানিক পত্র) ইস্যু করার জন্য চিঠির অনুলিপি দেয়া হয়েছে৷ এছাড়া সরকারের আরো সাত প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয়া হয়েছে অবগতি ও সহায়তার জন্য৷ চিঠিতে বলা হয়েছে, পুলিশের প্রধানসহ তিন জনের জার্মানি সফরের খরচ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বহন করবে৷
জানা গেছে গত ৮ অক্টোবর এই বিছানার চাদর ও বালিশের ডাবল কাভার সরবরাহের জন্য পুলিশ সদর দপ্তর থেকে দরপত্র আহ্বান করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়৷ কম্বল, অ্যাপুলেট, হ্যান্ড গ্লোভস, ডাবল পিলো কাভারসহ বেডশিট, সিঙ্গেল পিলো কাভারসহ বেডশিট, বডি ব্যাগ, কটন ভেস্টসহ ২১ ধরনের আইটেম সরবরাহের জন্য এই দরপত্র আহ্বান করা হয়৷ তারমধ্যে বালিশের ডাবল কাভারসহ বিছানার চাদর একটি আইটেম৷
সরকারে ই-প্রকিউর ওয়েবসাইটেও দরপত্রটি প্রকাশ করা হয়েছে ৭ অক্টোবর৷ তাতে এই দরপত্র আহ্বান ও মালামাল গ্রহণের জন্য পুলিশ সদ রদপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আতাউল কিবরিয়ার নাম উল্লেখ করা হয়েছে৷ আর ২৮ এপ্রিলের মধ্যে বালিশের ডাবল কাভারসহ বিছানার চাদর সরবরাহ করতে বলা হয়েছে৷
এবিষয়ে কথা বলার জন্য আইজি বেনজীর আহমেদকে পাওয়া যায়নি৷ মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠিয়েও জবাব মেলেনি৷ ফলে এই বিছানার চাদর সরবরাহের দায়িত্ব বাংলাদেশে কোন প্রতিষ্ঠান পেয়েছে, জার্মানির কোন প্রতিষ্ঠান থেকে আনা হচেছ, তারা বাংলাদেশ থেকে নেয়া চাদর ও বালিশের কাভার আবার বাংলাদেশেই রপ্তানি করছে কী না এবং তিনজনকে জার্মানিতে নিয়ে গেলে ওই প্রতিষ্ঠানের যে টাকা খরচ হবে তারা তা কীভাবে মেটাবে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান তা জানা সম্ভব হয়নি৷ আমদানি করতে কত টাকা খরচ হচেছ তাও জানা যায়নি৷
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (মিডিয়া এন্ড প্ল্যানিং) হায়দার আলি খান বলেন, ‘‘আমি এটার সাথে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নই৷ তাই কিছু বলতে পারব না৷’’
পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আতাউল কিবরিয়াকেও ফোনে পাওয়া যায়নি৷ তিনি এই দরপত্র প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত৷
অবশ্য এই সফরের জন্য মনোনিত আইজিপিসহ তিনজনের একজন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপ-সচিব মো. ফিরোজ উদ্দিন খালিফা বলেন, ‘‘আমি জার্মানি যাওয়ার ব্যাপারে তেমন কিছু জানি না৷ সেখানে আমার কাজ কী সে সম্পর্কেও আমার ধারণা নেই৷ একটি চিঠি পেয়েছি এই পর্যন্ত৷ আমি এখনো ভিসার জন্য আবেদন করিনি৷ যাবো কী না তাও এখনো বলতে পারছি না৷’’
বিছানার চাদর এবং বালিশের কাভার জার্মানি থেকে আনতে হবে কেন? বাংলাদেশে কি এগুলো পাওয়া যায় না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এই প্রক্রিয়ার সাথে আমি যুক্ত নই৷ আমি কীভাবে বলব?’’ একই প্রশ্নের জবাবে চিঠিতে স্বাক্ষরকারী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপ-সচিব মাহবুবুল আলম মজুমদার বলেন, ‘‘আমি তো আদিষ্ট হয়ে স্বাক্ষর করেছি৷ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তো আমি বলতে পারব না৷ সিদ্ধান্ত হয় অনেক উপরে৷’’
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িত ওমেগা স্টাইল লিমিটেডের এমডি আমিরুল ইসলাম জানান, ‘‘বিছানার চাদর, বালিশের কাভার এগুলোকে বলে হোম টেক্সটাইল৷ তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশ অনেক এগোলেও বাংলাদেশে ভালো মানের হোম টেক্সটাইল তৈরি করে পাঁচ-ছয়টি প্রতিষ্ঠান৷ কারণ এর খরচ পোশাক শিল্পের চেয়ে অনেক বেশি৷ এর ফেব্রিক ও রঙের বিশেষত্ব আছে৷ ওয়ালমার্টসহ আরো বড় বড় ক্রেতারা এখান থেকে হোম টেক্সটাইল নেয়৷ জাবের এন্ড জুবায়ের, পলমল গ্রুপসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হোম টেক্সটাইলে সারা দুনিয়ায় খ্যাতি অর্জন করেছে৷ তবে দেশের চাহিদা মেটাতে বাইরে থেকেও আমদানি করা হয়৷’’
পুলিশ সদর দপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা দাবি করেন, ‘‘বাংলাদেশের বাজারে বিছানার চাদরের সমস্যা হচ্ছে রঙ ঠিকমত হয় না৷ পুলিশের চাদর এবং বালিশের কাভারে একটি বিশেষ রঙ আছে৷ এ কারণেই জার্মানি থেকে আনা হচ্ছে৷’’
জাবের এন্ড জুবায়ের-এর নির্বাহী পরিচালক রাশেদ মোশাররফ জানান, ‘‘আমরা ১৩ বছর ধরে হোম টেক্সটাইল তৈরি করছি৷ আমরা বছরে এখন ২০০ মিলিয়ন ডলারের হোম টেক্সটাইল রপ্তানি করি অ্যামেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে৷ ইউরোপের জার্মানিসহ সব দেশেই আমাদের হোম টেক্সটাইল যায়৷ আরো পাঁচ-ছয়টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে আছে যারা আমাদের মত শতভাগ রপ্তানি করে৷’’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘দুই ধরনের প্রতিষ্ঠান আছে৷ আমাদের লাইসেন্স শতভাগ রপ্তানির জন্য৷ আবার দেশের বাজারে বিক্রির জন্যও লাইলেন্স নেয়া হোম টেক্সটাইলের প্রতিষ্ঠান আছে৷ এরকম লোকাল প্রডাক্ট-এর জন্য চার-পাঁচটি প্রতিষ্ঠান আছে যারা দেশের জন্য ভালো মানের হোম টেক্সটাইল উৎপাদন করে৷ আমাদেরই সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইসমাইল আঞ্জুমানারা টেক্সটাইল, ক্ল্যাসিক্যাল হোম টেক্সট এরকম৷ আবার যারা রপ্তানির জন্য তৈরি করে তাদের আলাদা লোকাল প্রোডক্ট-এর ইউনিটও আছে৷ তাই তারা স্থানীয় বাজারের জন্য চাহিদা অনুযায়ী কোয়ালিটি কন্ট্রোল করতে পারে৷ প্রতিবছর পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর প্রচুর বিছানার চাদর , বালিশের কাভার লাগে৷ এগুলো তারাই সরবরাহ করে৷ কয়েক লাখ পিস তারা এক সঙ্গে সরবরাহ করতে পারে৷ রঙ নিয়েও কোনো সমস্যা নেই৷
তিনি জানান, জার্মানি খুব সামান্যই হোম টেক্সটাইল উৎপাদন করে৷
তাহলে পুলিশ কি এবার বাংলাদেশ থেকে জার্মানিতে রপ্তানি করা বিছানার চাদর, বালিশের কাভার আবার সেখান থেকেই কিনে বাংলাদেশে আনছে? এর জবাবে তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ জার্মানি থেকে বিছানার চাদর বা বালিশের কাভার কিনে আনছে কী না আমার জানা নাই৷ তবে আগে দেশের ভিতর থেকেই কিনত৷ আর জার্মানির প্রডাক্ট হয়ে থাকলে তার দাম তো অনেক বেশি হবে৷’’