বসুর বাড়ি সংগ্রহশালার রূপান্তর
২৩ ডিসেম্বর ২০১৩ইংল্যান্ডে স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন-অ্যাভনে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বাড়িটি বহুদিন ধরেই একটি সংগ্রহশালা৷ অথবা সুইজারল্যান্ডের বার্ন-এ অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের বাড়িটি৷ ঠিক সেই আদলেই বিশিষ্ট বাঙালি জীববিজ্ঞানী আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর বাড়ি তথা কর্মস্থল পরিবর্তিত হবে ঐতিহ্য সংগ্রহশালায়৷
কলকাতার গ্যোটে ইনস্টিটিউট বা মাক্সম্যুয়েলার ভবনের উদ্যোগে বার্লিন রাষ্ট্রীয় সংগ্রহশালার দুই সংস্কার ও সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ মোনিকা ৎসেসনিক এবং হান্স হুরগেন হারাস সম্প্রতি কলকাতায় বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর ওই বাড়িটি ঘুরে গেলেন৷ তাঁদের সঙ্গে ছিলেন ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ট্রাস্ট ফর আর্ট অ্যান্ড কালচারাল হেরিটেজ', সংক্ষেপে ইনটাক-এর সদস্যরা৷ মূলত ইনটাক-এর ব্যবস্থাপনায় এবং জার্মান বিশেষজ্ঞের পরামর্শে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর এই বাড়িটি একদিকে যেমন হবে ঐতিহ্যের ধারক, তেমনই এই বিজ্ঞান সাধকের ব্যক্তিগত আদর্শ এবং জীবনচর্যারও নিদর্শন হয়ে থাকবে৷
আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ১৯০২ সালে তৎকালীন আপার সার্কুলার রোড, বর্তমানে তাঁরই নামাঙ্কিত রাস্তায় এই বাড়িটি বানিয়েছিলেন, যেখানে তিনি আজীবন বিজ্ঞানসাধনায় রত ছিলেন৷ বেতার তরঙ্গ এবং উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা নিয়ে তাঁর যুগান্তকারী গবেষণার কিছুটা অংশ এই বাড়িতেই, নিজস্ব গবেষণাগারে বসে তিনি করেছিলেন৷ তিনি এবং তাঁর স্ত্রী লেডি অবলা বসু এই বাড়িতেই আপ্যায়িত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইউরোপীয় দার্শনিক রোমাঁ রঁলা, নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ, স্বামী বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতা এবং প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহার মতো বিজ্ঞানীদের৷
জগদীশ চন্দ্র বসুর লেখা ডায়েরি অর্থাৎ রোজনামচা থেকে জানা যায়, তাঁর এই বাড়ি কীভাবে একদিকে উনবিংশ শতকে ব্রাহ্ম সমাজের ধর্মীয় আন্দোলন এবং অন্যদিকে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের, আর সেই সঙ্গে বাঙালির নবজাগরণের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল৷
আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর হাতে লেখা ডায়েরি ছাড়াও এই বাড়িতে সংগৃহীত আছে বিবিধ বৈজ্ঞানিক গবেষণার সরঞ্জাম, ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র, দুষ্প্রাপ্য চিত্রকলা, যার মধ্যে রয়েছে মুঘল মিনিয়েচার পেইন্টিং পর্যন্ত৷ ১৯৩১ সালে জগদীশ চন্দ্র বসু নিজেই একটি ট্রাস্ট বা অছি পরিষদ তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলেন, যে ট্রাস্ট এখনও পর্যন্ত ঐতিহাসিক এই বাড়িটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে৷ ২০০৯ সালে, জগদীশ চন্দ্র বসুর ১৫০-তম জন্মবার্ষিকীর সময় এই ট্রাস্টের পক্ষ থেকে ভারতের কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের কাছে আবেদন জানানো হয়েছিল, যাতে এই বাড়ি এবং তাঁর অমূল্য সংগ্রহের রক্ষণাবেক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া যায়৷ সংস্কৃতি মন্ত্রক ইনটাক-কে সেই দায়িত্ব দেয়৷ ইনটাক পরের দু-তিন বছরে বেশ কিছু মুঘল মিনিয়েচার, শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু এবং বিখ্যাত রুশ শিল্পী নিকোলাস রোয়োরিখের আঁকা ছবি পুনরুদ্ধার করে৷ এই কাজ চলাকালীনই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের কাছে ইনটাক-এর পক্ষ থেকে যে রিপোর্ট গিয়েছিল, তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের মনে হয়, স্রেফ সংস্কার বা পুনরুদ্ধার না করে এই আচার্য ভবনকে একটি জাতীয় বিজ্ঞান সংগ্রহশালা হিসেবে গড়ে তোলা উচিত৷
এই সন্ধিক্ষণে ইনটাক সাহায্য চায় বার্লিনের রাষ্ট্রীয় সংগ্রহশালার বিশেষজ্ঞদের, যাঁদের সঙ্গে ইনটাক আগেও বেশ কিছু প্রকল্পে কাজ করেছে এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংগ্রহশালা গড়ে তোলায় যাঁরা এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা৷ এই পর্যায়ে মধ্যস্থতার দায়িত্বে এগিয়ে আসে কলকাতার গ্যোটে ইনস্টিটিউট মাক্সম্যুয়েলার ভবন৷ ইতোমধ্যেই বার্লিন রাষ্ট্রীয় সংগ্রহশালার দুই বিশেষজ্ঞ এই ঐতিহাসিক ভবনটি ঘুরে দেখেছেন এবং সবকিছু দেখে তাঁরা এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছেন যে, চার তলা এই বাড়িটির প্রতিটি কোণা বিজ্ঞানসাধনার এক নিরবিচ্ছিন্ন ঐতিহ্যের নিদর্শন৷ কাজেই ঠিক সেই গুরুত্ব দিয়েই বাড়িটির সংস্কার এবং সেটিকে সংগ্রহশালায় রূপান্তরিত করার কথা ভাবা হচ্ছে৷
কিন্তু সেখানেই শেষ নয়৷ দুই জার্মান বিশেষজ্ঞ পরিকল্পনা করেছেন আধুনিক মাল্টিমিডিয়া প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর সময়কেও পুনরুজ্জীবিত করার৷ যেমন যে দুটি চেয়ারে মুখোমুখি বসে জগদীশ চন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই আলোচনা করতেন, চেষ্টা হবে সেই সংলাপ পুনরুদ্ধারের৷ এমনকি জগদীশ চন্দ্র বসুর ব্যবহৃত বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম পুনর্নির্মাণের একটা চ্যালেঞ্জও তাঁরা নিয়েছেন!