‘বিদেশি বর্জ্য নিয়ে শিল্প চালানোর যুক্তি নেই'
১৭ এপ্রিল ২০১৭ডয়চে ভেলে: সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, আপনি বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী ৷ আপনার কাছে প্রশ্ন – এই যে জাহাজ ভাঙাকে ‘শিল্প' বলা হয়, এটা নিয়ে আপনারা কী ধরনের কাজ করে থাকেন?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: জাহাজ ভাঙাকে নতুন করে শিল্প ঘোষণার কোনো প্রয়োজন ছিল না৷ শ্রম আইনে শিল্পের যে সংজ্ঞা, তার মধ্যে জাহাজ ভাঙা প্রথম থেকেই পড়ত৷ আদালত যখন জাহাজ ভাঙাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আদেশ দেওয়া শুরু করে, সে সময় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে কেবিনেট মিটিং হয়, তাতেই জাহাজ ভাঙাকে একটা ‘শিল্প' হিসেবে ঘোষণা করা হয়৷ তবে আমি যেটা বুঝি, এর পেছনে যে একটা রাজনৈতিক শক্তি আছে, সেটা আদালতসহ সমাজের অন্যদের বুঝিয়ে দিতে হবে৷ কারণ, আসলে এটা শিল্পের ধারে ধাছেও যায় না৷ যে ধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকলে এটাকে শিল্প বলতে পারতাম, জাহাজ ভাঙার ক্ষেত্রে তার কোনোটাই নেই৷
এই শিল্প থেকে সরকারের রাজস্ব আসে কেমন?
সঠিকভাবে এই হিসাবটা আমি বলতে পারব না৷ তবে সরকারের বিভিন্ন খাত থেকে যে রাজস্ব আসে, তার প্রথম ২০টার মধ্যে জাহাজ ভাঙা শিল্প নেই৷
দেশে ইস্পাতের চাহিদার কতভাগ আসে এ শিল্প থেকে?
২০০৯ সালে জাহাজ ভাঙা শিল্প মালিকদের পক্ষ থেকে একটা হিসাব দেওয়া হয়েছিল৷ সেখানে বলা হয় যে, ২৫ ভাগ এই শিল্প থেকে আসে৷ যেহেতু সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে গত তিন বছরে এর কর্মকাণ্ড বেড়ে গেছে, আমি ধরে নিচ্ছি যে, এটা বর্তমানে সর্বোচ্চ ৩৫ ভাগে হতে পারে৷ তবে এর বেশি কোনোভাবেই নয়৷ এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো যে, এই ইস্পাত অত্যন্ত নিম্নমানের৷ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা গবেষণায় দেখা গেছে, এটা দিয়ে চার তলার বেশি বাড়ি করা ঠিকই না৷
বাংলাদেশে জাহাজ ভাঙা শিল্পে পরিবেশ ছাড়পত্র কি ঠিকমতো নেওয়া হয়?
একেবারেই ঠিকমতো নেওয়া হয় না৷ পরিবেশ অধিদপ্তর তড়িঘরি করে এটাকে রক্ষা করতে এবং আদালতের আদেশকে পাশ কাটাতে কিছু কিছু ছাড়পত্র দিয়েছিল৷ সেই ছাড়পত্র পড়লেই আপনি দেখবেন যে, সেগুলো ছিল শর্তসাপেক্ষ ছাড়পত্র৷ এক থেকে ৫২ পর্যন্ত শর্ত দেওয়া হয়েছিল৷ ১০ মাস পর পরিবেশ অধিদপ্তর যখন ওখানে ‘ফিল্ড সার্ভে' করে, তখন দেখে ৩-৪টি শর্ত ছাড়া সবগুলো শর্তই তারা ভাঙছে৷
জাহাজ ভাঙার আগে সাধারণত তেজস্ক্রিয় পদার্থের অস্তিত্ব নিয়ে একটা পরীক্ষা হয়৷ আমাদের এখানে কি এটা করা হয়?
একেবারেই করা হয় না৷ আর করা হলেও তা ভুল রিপোর্ট দিয়ে করা হয়৷
এই শিল্পের কারণে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে....তা কোন পদার্থ সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে?
ক্ষতি অনেক পদার্থই করছে৷ এর মধ্যে ওয়েস্ট ওয়েল, লেড, টিসিবি ও অ্যাসবেস্টাস সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে৷ অ্যাসবেস্টাস এমন একটি জিনিস, যা বাতাসে যদি এক কণাও থাকে এবং সেটা যদি আপনি নিঃশ্বাসের সঙ্গে নেন, তবে ভবিষ্যতে আপনার ক্যানসার হতে পারে৷ এটার কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই৷ জাহাজ ভাঙা শিল্প যে এলাকায় চলে, সেই উপকূলীয় এলাকায় বন সম্পূর্ণ উজার করে দেয়া হয়েছে৷ এই বনই কিন্তু একসময় প্রাকৃতিক ‘রক' হিসেবে কাজ করত সাইক্লোনের বিরুদ্ধে৷ ঐ এলাকার পানিতে কোনো মৎস সম্পদ নেই৷ মাটি এতটাই দূষিত হয়ে গেছে যে, সেখানে নতুন করে কিছু রোপণ করবেন, সেই সুযোগও নেই৷
শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড গড়ে তুলতে গেলে মূলত কী কী প্রয়োজন হয়?
শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড যদি পরিবেশসম্মতভাবে গড়ে তুলতে হয়, তাহলে এটা কোনোভাবেই সমুদ্রের পাড়ে হতে পারবে না৷ অথচ সেটাই আমাদের দেশে হচ্ছে৷ এটাকে আসলে হতে হবে ‘ড্রাই-ডকে'৷ তাছাড়া এ কাজটা এমন একটা জায়গায় করতে হবে, যেখানে জাহাজটা ভাঙা যাবে আবদ্ধ পরিবেশে৷ আমাদের দেশে উন্মুক্ত ‘বিচে' যে কর্মকাণ্ড চালানো হয়, সেটাকেই জাহাজ ভাঙা শিল্প বলা হচ্ছে৷ এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ ড্রাই-ডকে কন্টেইনার সুবিধা, শ্রমিক নিরাপত্তার সবরকম ব্যবস্থাসহ একটা আবদ্ধ পরিবেশে যখন জাহাজ ভাঙার কাজ হবে, একমাত্র সেটাকেই আমরা জাহাজ ভাঙা শিল্প বলতে পারব৷ এটা সমুদ্রের পাশে হতে পারে, কিন্তু পাড়ে নয়৷ যেখানে এটা ‘অপারেট' করবে সেখানে ঢালাই থাকতে হবে এবং সমস্ত দূষণকে ‘কন্টেইন' করার সুযোগ থাকতে হবে৷
এই শিল্পে কর্মীদের মৃত্যুর হার কেমন?
বাংলাদেশে প্রত্যেক মৃত্যু ‘রিপোর্টেড' হয় না৷ আমাদের হিসেব অনুযায়ী, প্রতি মাসে অন্তত তিনজন শ্রমিকের মৃত্যু হচ্ছে এ শিল্পে৷
কর্মীদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা রক্ষায় বিশেষ কোনো আইন আছে কি?
আইন আছে৷ দু'টি মন্ত্রণালয় দু'টি আইন করে বসে আছে৷ পরিবেশ মন্ত্রণালয় একটি ও শিল্প মন্ত্রণালয় একটি৷ এখানে একটা জিনিস বলে রাখা ভালো যে, শ্রম মন্ত্রণালয়ের ওখানে কোনো ধরনের অস্তিত্ব নেই৷ কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তারা যায় না৷ কোনো শ্রমিকের মৃত্যু হলে তারা মালিকদের পক্ষ নিয়ে একটা সাজানো গল্পের মতো রিপোর্ট দিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে৷ তাদের তদারকি একেবারেই নেই৷ শ্রমিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য যে ‘ডিভাইসগুলো' দেওয়ার কথা, সেগুলো শুধুমাত্র কেউ পরিদর্শনে গেলে দেওয়া হয়৷ দেখলেই বোঝা যাবে, কারণ, ওগুলো ঝকঝক করে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত নিরাপত্তার সরঞ্জাম নেই, নেই অগ্নি নির্বাপনের ব্যবস্থাও৷ শ্রমিকদের দিয়ে সমস্ত কাজ ‘ম্যানুয়ালি' করানো হয়৷ মানে তাঁরা খালি হাতে পুরো জাহাজটা ভাঙে৷
অনেক দেশে, বিশেষ করে ভারতের গুজরাটে আমরা ইয়ার্ডের পাশে হাসপাতাল দেখেছি৷ বাংলাদেশে কি এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা আছে?
আদালতের নির্দেশে বাংলাদেশ শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড একটি হাসপাতাল করেছে৷ এখানে দু'টি বিষয় বিবেচনায় রাখা দরকার৷ আদালত বলেছিল, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অধীনে থাকবে এই হাসপাতাল৷ কিন্তু শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের মালিকরা এটা তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় রেখেছে৷ আরেকটা বিষয় হলো, যখন তারা লাশগুলো তাদের নিজস্ব হাসপাতালে নিয়ে যাবে, তখন আমরা তা কিন্তু গুণতেও পারব না৷ কারণ, তখন তারা তাদের মতো করে দুর্ঘটনার কারণ সাজাবে৷ যেমন-তেমন করে চিকিৎসা দিয়ে বিদায় করে দেবে৷ গুজরাট অবশ্য গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অনেক নীচে অবস্থান করছে৷
বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙা শিল্প নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মাঝেমধ্যেই আমরা সমালোচনা হতে দেখি, এতে কোনো কাজ হয় কি?
কিছু কিছু কাজ হয়৷ যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটা আইন করেছে৷ সেখানে তারা বলেছে, তাদের পতাকাবাহী জাহাজ উন্মুক্ত বিচে ভাঙা যাবে না৷ তাদের জাহাজগুলোর ক্ষেত্রে কিছু কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে৷ এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে ইয়ার্ডগুলোকে পরিবেশসম্মত বলে ঘোষণা করবে, কেবলমাত্র সেখানেই তাদের পতাকাবাহী জাহাজ যাবে৷ এটা বড় একটা বিজয়৷ আরেকটা বিজয় হলো, এর ফলে আপনি যা খারাপ, তাকে খারাপ বলতে পারছেন৷
অনিয়ম দূর করায় পরিবেশ অধিদপ্তরের ক্ষমতা কতটুকু?
পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অনেক ক্ষমতা৷ শ্রম মন্ত্রণালয়েরও অনেক ক্ষমতা৷ কিন্তু মুশকিল হলো, এটা শিল্প মন্ত্রণালয় ছলে-বলে-কলে-কৌশলে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে৷ পরিবেশ অধিদপ্তর যদি তাদের নিজের ‘ম্যান্ডেটের' প্রতি ন্যূনতম বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করত, তাহলে এই শিল্পে শ্রমিক মৃত্যুর হার অবশ্যই আমরা কমিয়ে আনতে পারতাম৷ এমনকি পরিবেশ দূষণের হারও হয়ত আমরা কিছুটা কমাতে পারতাম৷
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড রক্ষায় কী করা প্রয়োজন?
এই উন্মুক্ত বিচকে নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন৷ বিচের মধ্যে জাহাজ ভাঙার কর্মকাণ্ড করা যাবে না৷ করতে হলে এটা ‘ড্রাই-ডকে' করতে হবে৷ যে সমস্ত জাহাজ বিদেশ থেকে আসে, সেগুলো হয় বিদেশ থেকেই পরিষ্কার হয়ে আসবে অথবা বাংলাদেশে এ সব বর্জ্য কন্টেইনারে রাখা হবে এবং পরবর্তিতে সেই কন্টেইনারগুলো আবারো বিদেশে ফেরত পাঠানো হবে৷ অন্য দেশের বর্জ্য নিয়ে শিল্প চালানোর কোনো যুক্তি থাকতে পারে না৷ আন্তর্জাতিক আইনও তাই ‘ডিমান্ড' করে৷
এর বিরুদ্ধে তো আপনি দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন৷ আদালত থেকে শুরু করে রাস্তার আন্দোলন পর্যন্ত৷ সেই আন্দোলনের সর্বশেষ অবস্থা কী?
সর্বশেষ দু'টি মন্ত্রণালয় দু'টি বিপরীতধর্মী বিধিমালা করে রেখেছে৷ শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় সরকারের যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা নেই, তাই এতে প্রমাণিত হয়৷ আর সর্বশেষ শিল্প মন্ত্রণালয় একটা আইন করে কেবিনেটে দিয়েছে৷ আইনটি কোনোভাবেই আদালতের নির্দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়৷ এই আইনটি এমন একটি আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে হচ্ছে, যে আইনটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রয়োজনীয় সমর্থনের অভাবে কার্যকরই হয়নি৷ এখন এমন একটা অন্যায়কে আইনগত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে রাজনৈতিক পর্যায় থেকে৷ আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, শ্রমিকদের ন্যূনতম ক্ষতিপূরণ পাইয়ে দেওয়ার জন্য৷ আদালতের আদেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন বা বিধিমালা যাতে না হয়, সেজন্য বিষয়টা আমরা আদালতের নজরে আনারও চেষ্টা করছি৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷