ভারতে আটকে পড়েছে তিন তালাক আইন
২ জানুয়ারি ২০১৯গত এক বছরে দু-বার তিন তালাকবিরোধী আইনের খসড়া পেশ হয়েছে সংসদে৷ প্রতিবার আটকে পড়েছে৷ প্রস্তাবিত আইনটির ভবিষ্যৎ এখন ঘোর অন্ধকারে৷
নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্যা, সমাজসেবী সরমিনা বেগম বলছেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার যে বিল এনেছে তা ইসলামবিরোধী৷ মুসলিম দম্পতির একে অপরের সঙ্গে বোঝাপড়া না হলে তাঁরা আলাদা থাকতেই পারেন, তাঁদের বোঝাপড়ার জন্য সময় দেওয়া হয়৷ মুসলিম আইনে একসঙ্গে তিনবার তালাক দেওয়া যায় না৷ তিন বার তালাক দেওয়ার মধ্যে নির্দিষ্ট ব্যবধানের উল্লেখ আছে৷ বিষয়টি মুসলমান সম্প্রদায়ের নিজস্ব৷ এখানে সরকার অথবা অন্য কারো নাক গলানো অনুচিত৷ তাছাড়া স্বামীকে যদি জেলে পাঠানো হয়, তাহলে স্ত্রীর কী হবে? খোরপোষ কে কীভাবে দেবে? ভারতে মুসলিম মহিলাদের ৭০ শতাংশই সামাজিক ভাবে সচেতন নন৷ প্রকৃত সমাধান করতে হলে তাঁদের সচেতন করতে হবে৷ আইন করে নয়৷''
কংগ্রেস ও তৃণমূল-সহ সবকটি বিরোধী দলের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও গত ২৭ ডিসেম্বর লোকসভায় পাশ হয়েছে তিন তালাক বিল, যার আইনি নাম ‘দ্য মুসলিম উইমেন(প্রোটেকশন অফ রাইটস অন ম্যারেজ) বিল ২০১৮'৷ এর আগে একই বিল লোকসভায় পাশ করে একইভাবে রাজ্যসভায় পেশ করে বিফল হয়েছে সরকার৷ রাজ্যসভায় সরকার পক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, বিরোধীরা শক্তিশালী৷ তার ওপর তিন তালাক বিলের বিরোধিতায় বিরোধীদের পাশে দাঁড়িয়েছে এআইএডিএমকে৷ এই পরিস্থিতিতে সাধারণ ভোটাভুটির মাধ্যমে তিন তালাক বিল পাশ করানো অসম্ভব৷ আবার বিরোধীদের দাবি মেনে সরকার যদি বিলটিকে যৌথ সংসদীয় সিলেক্ট কমিটিতে পাঠায়, তাহলে মোদী সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কমিটির সুপারিশ পেশ ও বিল পাশ প্রায় অসম্ভব হবে৷ তাই বিলের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়ের যথেস্ট অবকাশ রয়েছে৷ স্বভাবতই বেকায়দায় মোদী সরকার৷ তবে, অভিজ্ঞ মহলের মতে, রাজ্যসভায় বিলটি আটকে গেলেও আগামী লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে তা তুলে ধরবে ভারতীয় জনতা পার্টি৷
পশ্চিমবঙ্গে তিন তালাক-বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী শালিমা হালদার তিন তালাক বিলকে সর্বতোভাবে সমর্থন করেন৷ তিনি বলেন,‘‘এতদিন মুসলিম মহিলাদের পণ্য হিসেবে দেখা হতো৷ তাঁদের কোনো মতের মর্যাদা দেওয়া হতো না৷ শরিয়ত আইনেও তাঁদের কোনো অধিকার দেওয়া হয়নি৷ তাঁর কথায়, ‘‘যে কোনো কারণে স্ত্রীকে পছন্দ না হলেই মুসলিম স্বামীরা ঘুমের ঘোরে বা নেশার ঘোরে তিনবার তালাক দিলেই বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যেত৷ মেয়েদের জীবন যেন কচু পাতার ওপর জল! এখন বিরোধীদের উচিত এই বিলকে সমর্থন করা৷ কারণ, দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে তারা কিছু করেনি৷ এখন যখন স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে আইন তৈরি হচ্ছে, তখন বিরোধিতা কাম্য নয়৷ মুসলিম ভোটবাক্সের দিকে তাকিয়ে বিরোধিতা করছেন বিরোধী দলগুলি৷''
মূলত সংসদীয় কমিটির স্ক্রুটিনি ও পরামর্শকে দূরে সরিয়ে রেখে বিল পাশের বিরোধিতায় সরব হয়েছে বিজেপিবিরোধী দলগুলি৷ তাছাড়া প্রস্তাবিত আইনে মুসলিম স্বামীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি শাস্তির ব্যবস্থাস (তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড) চাইছে না তারা৷ প্রস্তাবিত আইনটিকে ‘মুসলিমবিরোধী' বলেও মনে করছে কয়েকটি দল৷ এ অবস্থায় নিজেদের মধ্যে আগেভাগে বৈঠক করে বিলটিকে ঠেকানোর রণকৌশল ঠিক করে নিয়েছিলেন কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম, সিপিআই, সপা, বসপা, আরজেডি, টিডিপি, ডিএমকে-সহ অন্যান্য দলের নেতারা৷ রাজ্যসভায় বিলটি আনেন আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ৷ অধিবেশন শুরু হতেই বিরোধীদের হইচইয়ের জেরে দফায় দফায় অধিবেশন মূলতবি হয়েছে৷
উল্লেখ্য, মুসলিম দম্পতির বিবাহবিচ্ছেদে তিন তালাক প্রথাকে ‘স্বেচ্ছাচার' আখ্যা দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট৷ কেন্দ্রীয় সরকারকে আইন প্রণয়নের কথাও বলেছিল আদালত, বিল এনেছে সরকার, লোকসভায় পাশ হয়েছে৷ এরপর রাজ্যসভায় পাশ হলে সেটি রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে৷ তিনি স্বাক্ষর করলেই তৈরি হবে আইন৷ নতুন বিলে তিন তালাককে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে৷ সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানার সংস্থান রয়েছে৷ পাশাপাশি ওই সময়ে স্ত্রীর খোরপোষের বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে৷ বিরোধীদের প্রশ্ন, স্বামীর কারাদণ্ড হলে স্ত্রী'র ভরণপোষণের দায়িত্ব নেবেন কে? সবমিলিয়ে তিন তালাক বিল আইনে রূপান্তর হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করছে অভিজ্ঞ মহল৷ এমন ভাবনার পেছনে যুক্তি হলো, সংসদের চলতি শীতকালীন অধিবেশনই নরেন্দ্র মোদী সরকারের শেষ অধিবেশন৷ এরমধ্যে বিল পাশ না হলে সেটি পাশ করাতে পারবে আগামী সাধারণ নির্বাচনের পর গঠিত নতুন সরকার৷ আপাতত বিশ বাঁও জলে তিন তালাক বিল৷