বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় মা - এক
১৩ ডিসেম্বর ২০১১রবীন্দ্রনাথের জন্মের সময় সারদা দেবীর বয়স ৩৪-এর মত৷ রবীন্দ্রনাথের রচনায়, রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিতে মায়ের উপস্থিতি অবিশ্বাস্য রকম কম৷ রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন তেরো বছর দশ মাস, তখন তিনি মাকে হারান৷ ততোদিনে তাঁর কবিতা লেখা শুরু হয়ে গেছে৷ কবিতা শুনিয়ে সন্দিগ্ধ ও মুগ্ধ করেছেন সবাইকে৷ এমনকি সেকালের বিখ্যাত সাময়িক পত্র ‘তত্ত্ববোধিনী'-তে ‘অভিলাষ' নামে তাঁর একটি দীর্ঘ কবিতাও ছাপা হয়ে গেছে৷ কবিতার নিচে অবশ্য রবীন্দ্রনাথের নাম ছিলো না৷ লেখা হয়েছিলো ‘দ্বাদশ বর্ষীয় বালকের রচিত'৷
মায়ের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেও তিনি মাকে নিয়ে কোনো কবিতা লেখেননি৷ বরং কয়েক মাস পরে ‘হিন্দু মেলার উপহার' শিরোনামে গুরুগম্ভীর দেশাত্মবোধক জাতীয় উদ্দীপনামূলক কবিতা লিখেছেন৷ এটি তাঁর স্বনামে মুদ্রিত প্রথম কবিতা৷
রবীন্দ্রনাথের রচনায় মা বা জননীর উল্লেখ যে নেই, তা নয়৷ তবে সেই মা হলেন দেশ জননী, জগজ্জননী অথবা নিজের সৃষ্ট চরিত্রের মা, নিজের মা নয়৷ মায়ের মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর পর সুরেশচন্দ্র সম্পাদিত শারদীয় সংকলন ‘আগমনীতে' ‘মাতৃবন্দনা' শিরোনামে তাঁর ছ'টি কবিতা মুদ্রিত হয়৷ সেখানে, অধিকাংশ সমালোচকের বক্তব্য - তিনি নিজের মায়ের বন্দনা করেননি৷
এমন কি ‘শিশু' অথবা ‘শিশু ভোলানাথ'-এ যে মায়ের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, তার মধ্যেও তাঁর নিজের মায়ের ছায়া অথবা মাতৃস্নেহ কোনোটাই প্রতিফলিত হয়নি৷ বস্তুত যে মায়ের কথা এখানে বলা হয়েছে সেই মায়ের সরব উপস্থিতিও এই সব রচনার মধ্যে নেই৷ মা এখানে নিতান্তই উপলক্ষ্য মাত্র, শিশুর কথার নীরব শ্রোতা, শিশুর স্বপ্নযাত্রার নীরব সঙ্গিনী৷
মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে
তুমি যাচ্ছ পাল্কিতে মা চড়ে
দরজাদুটো একটু ফাঁক করে
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার 'পরে
টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে৷
মায়ের এই নীরব ভূমিকা ‘সহজ পাঠ-২', ‘শিশু', শিশু ‘ভোলানাথ'-এর মা বিষয়ক সকল রচনাতেই লক্ষ্য করা যায়৷
মা তাঁকে কেমন স্নেহ করতেন, আদর করতেন, তার স্মৃতিমেদুর প্রতিফলন রবীন্দ্রনাথের রচনায় খুঁজে পাওয়া যায় না৷ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ঘরোয়া'-তে রবীন্দ্রনাথের মাতৃস্মৃতি উদ্ধৃত করেছেন রবীন্দ্রনাথের জবানিতে, ‘‘মাকে আমরা পাইনি কখনো, তিনি থাকতেন তাঁর ঘরে তক্তাপোশে বসে, খুড়ির সঙ্গে তাস খেলতেন৷ আমরা যদি দৈবাৎ গিয়ে পড়তুম সেখানে, চাকররা তাড়াতাড়ি আমাদের সরিয়ে আনতেন যেন আমরা একটা উৎপাত৷ মা যে কী জিনিস তা জানলুম কই আর৷ তাইতো তিনি আমার সাহিত্যে স্থান পেলেন না৷''
রবীন্দ্রনাথের মা সারদা সুন্দরী দেবী সন্তানদের প্রতি উদাসীন ছিলেন, এমন অভিযোগ অনেকে করেছেন৷ সরলা দেবী চৌধুরানী নিজের মা স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘মায়ের আদর কী তা জানিনে, মা কখনো চুমু খাননি, গায়ে হাত বোলাননি৷ মাসিদের ধাতেও এ সব ছিল না৷ শুনেছি কর্তাদিদিমার কাছ থেকেই তাঁরা এই উদাসীন্য উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন৷ বলাবাহুল্য, এই কর্তাদিদিমা হলেন রবীন্দ্রনাথের মা সারদা দেবী আর স্বর্ণকুমারী দেবী হলেন রবীন্দ্রনাথের বড়ো বোন৷
বস্তুত পক্ষে, সন্তানদের ব্যাপারে সারদা দেবীর এই উদাসীন্য তাঁর মন থেকে ছিলো না, তা ছিলো বনেদী বাড়ির প্রতিষ্ঠিত প্রথা৷ সরলা দেবী চৌধুরানী লিখেছেন, ‘‘সে কালের ধনীগৃহের আর একটি বাঁধা দস্তুর জোড়াসাঁকোয় চলিত ছিল৷ শিশুরা মাতৃস্তন্যের পরিবর্তে ধাত্রীস্তন্যে পালিত ও পুষ্ট হত৷ ভূমিষ্ট হওয়ামাত্র মায়ের কোল ছাড়া হয়ে তারা এক একটি দুগ্ধদাত্রী দাই ও এক একটি পর্যবেক্ষণকারী পরিচারিকার হস্তে ন্যস্ত হত, মায়ের সঙ্গে তাদের আর সম্পর্ক থাকত না৷ জন্মের পরেই ঠাকুরবাড়ির এই রীতি অনুযায়ী শিশু রবীন্দ্রনাথকে মায়ের কোল থেকে স্থানান্তরিত হতে হয় ধাত্রীমাতার কোলে৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের ধাত্রীমাতার নাম ছিলো দিগম্বরী, সবাই ডাকতেন ‘দিগমী' নামে৷
পনেরো সন্তানের জননী সারদা দেবীর সর্বকনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন রবীন্দ্রনাথ৷ সন্তানদের প্রতি মায়ের যে স্নেহ ও মমতা, চৌদ্দ সন্তানের পর রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত তা কতোটা পৌঁছেছিলো তা অবশ্য বিবেচনার বিষয়৷ রবীন্দ্রনাথের প্রথম বোন সৌদামিনী দেবী লিখেছেন, ‘‘আমার মা বহু সন্তানবতী ছিলেন এই জন্য তিনি আমাদের সকলকে তেমন করিয়া দেখিতে পারিতেন না...৷''
মা সারদা দেবীর স্নেহ ও আদর যে শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথে পৌঁছায়নি তার খানিকটা প্রমাণ পাওয়া যায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরোয়াতে'৷ ‘ঘরোয়াতে' অবনীন্দ্রনাথ সৌদামিনী দেবী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি উদ্ধার করেছেন, ‘‘আমার বড় দিদিই আমাকে মানুষ করেছেন৷ তিনি আমাকে খুব ভালোবাসতেন৷ মার ঝোঁক ছিল জ্যোতিদা' আর বড়দার উপরেই৷ আমি তো তাঁর কালো ছেলে৷ অবনীন্দ্রনাথ অবশ্য মন্তব্য করেছেন, ‘‘সেই কালো ছেলে দেখো জগৎ আলো করে বসে আছেন৷''
প্রতিবেদন: ফরহাদ খান
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক