বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার মান বাড়ছে?
২৭ এপ্রিল ২০১৮অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য দেয়া হয় বলে অভিযোগ আছে৷
বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় নতুন দু'টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি দিয়েছে৷ বিশ্ববিদ্যালয় দু'টি হলো: বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহ মখদুম ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটি৷ বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয় পার্বত্য জেলা বান্দরবানে এবং প্রতিষ্ঠাতা পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উ শৈ সিং৷ শাহ মখদুম ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটি রাজশাহীতে এবং এর প্রতিষ্ঠাতা বিএম শামসুল হক৷
এর আগে ১৮ এপ্রিল খুলনায় খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহীতে আহসানিয়া মিশন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নামে দু'টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল৷ জানা গেছে, এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা আহসানিয়া মিশনের সভাপতি কাজী রফিকুল আলম৷ ঢাকার তেজগাঁওয়ে অবস্থিত আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাও তিনি৷
গত ২৯ জানুয়ারি জেডএনআরএফ ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় নামে আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হয়৷ এ বিশ্ববিদ্যালয়টি হবে রাজধানীর গুলশানে৷ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা ড. এম জুবায়দুর রহমান নামের একজন৷
গত ৯ বছরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে ৪৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেয়া হয়েছে৷ এখন মোট ১০১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যাল হলেও অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চালাচ্ছে ৯৫টি৷
আওয়ামী লীগের সবশেষ দুই মেয়াদে ৪৭টির মধ্যে ২০১২ সালে ১৬টি, ২০১৩ সালে ১০টি, ২০১৪ সালে ২টি, ২০১৫ সালে ৩টি , ২০১৬ সালে ৬টি , ২০১৭ সালে ৫টি এবং ২০১৮ সালে এ পর্যন্ত ৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেয়েছে৷
এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের মধ্যে আছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সাংসদ মহীউদ্দীন খান আলমগীর, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাংসদ নজরুল ইসলাম, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এনামুল হক শামীম, এ এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী, সিলেটের গোলাপগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা ইকবাল আহমেদ চৌধুরী, সরকারদলীয় সাংসদ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সাবেক সদস্য দুর্গাদাস ভট্টাচার্য, ব্যবসায়ী জয়নুল হক সিকদার, সাবেক আইনমন্ত্রী এবং সাংসদ আবদুল মতিন খসরু, খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও এবারের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উ শৈ সিং, বি এম শামসুল হক, কাজী রফিকুল আলম, ড. এম জুবায়েদুর রহমানসহ আরো কয়েকজন নেতা ও ব্যবসায়ী বিভিন্ন নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পান৷ এছাড়া পুরোনো একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদারসহ কয়েকজন যুক্ত হন৷
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ও দলীয় বিবেচনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হয়৷
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে মোট ১৮টি নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে বলে জানিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান৷ তারপর থেকে এ পর্যন্ত ১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেয়েছে৷ জানা গেছে, আরো অন্তত ১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এ বছর অনুমোদন পেতে পারে৷ আবেদন জমা আছে শতাধিক৷
বাংলা দৈনিক প্রথম আলো এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ‘‘ইতিমধ্যে কার্যক্রম চালানো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগই আইনের শর্ত মেনে চলছে না৷ গত মার্চ পর্যন্ত ৩০টিতে আচার্যের নিয়োগ করা উপাচার্য নেই, সহ-উপাচার্য নেই ৭০টিতে৷ বারবার সময় দিয়েও পুরোনো ৫১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ১৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গভাবে নিজস্ব ক্যাম্পাসে গেছে৷ সব মিলিয়ে নিয়মের মধ্যে চলছে ১৫ থেকে ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়৷ বাকিগুলোর বিরুদ্ধে রয়েছে শিক্ষাবাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ৷''
ইউজিসির ওয়েব সাইট থেকে জানা যায়, অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চালু করে ৯৫টি বিশ্ববিদ্যালয়৷ এর মধ্যে অনন্ত তিনটি বিশ্ববিদ্যায় অবৈধভাবে আউটার ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে৷ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে নিয়ম না মানার কারণে৷ একটি বিশ্ববিদ্যালয় অবৈধ ক্যাম্পসে পরিচালিত হচ্ছে৷ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় অবৈধ করার পর আদালতের আদেশ নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে৷
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার বিবেচনায় এখন পর্যন্ত ১৫-২০টি ইউনিভার্সিটি আছে যাদের মান মোটামুটি ভালো৷ ২৫-৩০টি আছে যাদের মান বলতে কিছু নেই৷ আর বাকি ৪০-৫০টি চলে বা মধ্যম মানের৷''
তিনি বলেন, ‘‘কোনো কিছু এক্সপান্ড করার আগে কোয়ালিটি নিশ্চিত করতে হয়, নাহলে কোয়ালিটি সাফার করে৷ পাবলিক এবং প্রাইভেট দুই ক্ষেত্রেই কোয়ালিটি অব এডুকেশন এবং রিসার্চে অগ্রগতি হয়নি৷ আমি ইউজিসির চেয়ারম্যান থাকাকালে চেষ্টা করেছিলাম প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির মান অনুযায়ী গ্রেডিং করতে, কিন্তু তা পারিনি নানা কারণে৷ উচ্চশিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ কমিশনও করার চেষ্টা করেছিলাম৷ তা-ও করতে পারিনি৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিলেই তো হবে না, ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার জন্য যথেষ্ট দক্ষ জনশক্তি আছে কিনা, তারা মানসম্মত শিক্ষা দিতে পারবেন কিনা, নিশ্চয়ই সরাকার তা দেখবে বলে আশা করি৷''
ইউজিসি'র আরেকজন সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা অনেক কঠিন প্রশ্ন৷ একশ'র বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যার অধিকাংশই মান অর্জন করতে পারেনি, কার্যকরও হতে পারেনি৷ অনেকগুলো বন্ধই করে দেয়া উচিত৷ তারপরও নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া ঠিক কিনা? ঠিক এই বিচেনায় যে. নতুনদের মধ্যেও কেউ হয়তো ভালো করতে পারে৷ এটা আমার অ্যাকাডেমিক অভিমত৷ যদি নতুনদের সুযোগ দেয়া না হয় তাহলে তো মানসম্পন্ন নয় এমন বিশ্ববিদ্যালয়ই টিকে থাকবে৷ তবে নতুনরা কেমন করবে, তাদের অবকাঠামো ও দক্ষ জনশক্তি আছে কিনা, সরকার ও ইউজিসি সেটা দেখে কিনা সেটা একটা প্রশ্ন৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘আমাদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সুশাসনের অভাব আছে৷ কিভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি দেয়া হচ্ছে, অনুমোদন পাওয়ার পর শর্ত অনুযায়ী হচ্ছে কিনা, মান সম্পন্ন হচ্ছে কিনা, তা তদারকি হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে৷ এক কথায় উত্তর– সঠিকভাবে হচ্ছে না৷ এখন গ্র্যাজুয়েটদের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে৷ বিবিএ এমবিএ পাশ করেও কাজ পাচ্ছেন না৷ তাই মান নিয়ন্ত্রণ এখন জরুরি হয়ে পড়েছে৷''
তবে এ বিষয়ে জানতে ইউজিসি'র বর্তমান চেয়াম্যান অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নানের সঙ্গে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি৷
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে এখন ১০১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৪০টি এবং তিনটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে৷ ১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হওয়ার পর দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন শুরু হয়৷
দেশে এতগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকা কি আপনি সমর্থন করেন? লিখুন নীচের ঘরে৷