বিশ্বভারতী: উপাসনা মন্দিরে আচার্য আদিবাসী সাফাইকর্মী
১৬ জুলাই ২০২০শান্তিনেকতনে বুধবারের উপাসনায় একসময় আচার্যের আসনে বসতেন রবীন্দ্রনাথ নিজে। কখনও ক্ষিতিমোহন সেনরা। উপাসনা মন্দিরে ব্রহ্মোপসনায় সেই আচার্যের আসনে এ বার বসলেন এক আদিবাসী সাফাই কর্মী, কালীচরণ হেমব্রম। করোনায় যখন সব বন্ধ, তখন কালীচরণরা রোজ এসেছেন। মন্দির, আশপাশের বাগান, চত্বর সাফ করে গিয়েছেন নিয়মিত। সেই কাজের পুরস্কার পেলেন কালীচরণবাবু।
আচার্যের আসনে যখন বসেছেন, তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না তাঁর। যে মন্দিরে এতদিন শুধু সাফাইয়ের অধিকার ছিল তাঁর, সেখানে আচার্য হয়ে বসতে পারবেন? কালীচরণবাবু বলেছেন, ''ভাবতে পারিনি, আমি এই স্বীকৃতি পাব। এই সম্মান আমার জীবনের সেরা পাওনা হিসাবে থাকবে।''
এ এমন এক উপাসনা মন্দির, যার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ইতিহাস। ১৮৯২ সালে উপাসনা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ। প্রতি বুধবার সেখানে উপাসনা হয়। মাঘোৎসব, খ্রিস্টোৎসব, দোলের মতো অনুষ্ঠানের সময়ও বিশেষ উপাসনা হয়। রঙিন কাচ দিয়ে তৈরি এই উপাসনা মন্দিরের আলাদা সৌন্দর্য আছে। সেখানে আচার্যের আসনে সম্প্রতি বিশ্বভারতীর বাইরের লোকেদেরও ডাকা হচ্ছে, যাঁরা নিজেদের কাজের ক্ষেত্রে ছাপ রেখেছেন। থানার ওসি কস্তুরী মুখোপাধ্যায়, চিকিৎসক অনির্বাণ দাশগুপ্ত, নিরাপত্তাকর্মী রূপা পালকে আগে মন্দিরের আচার্য করা হয়েছে। কিন্তু দলিত সাফাইকর্মীকে বোধহয় এরকম সম্মান আগে দেওয়া হয়নি।
তাঁর জীবনকালে জাতপাত, অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে নিজের লেখার মধ্যে দিয়ে লড়াই করে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। চণ্ডালিকায় যখন অচ্ছুৎ বলে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে জল দিতে চায়নি চণ্ডালকন্যা তখন, সেই সন্ন্যাসী বলেছিলেন, ''যে মানব তুমি, সেই মানব আমি কন্যা।'' এটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের ভাবনার মূল কথা। মানুষে মানুষে কখনও জাতপাতের ভেদাভেদ করা যায় না। তাই তিনি অচলায়তন ভাঙতে চেয়েছেন, তাসের দেশের নিয়মতান্ত্রিকতা ঘুচিয়ে খোলা হাওয়া বইয়ে দিয়েছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানে এক আদিবাসী সাফাই কর্মীকে উপাসনা মন্দিরের আচার্য করে রবীন্দ্রনাথের মূল ভাবনার রূপায়ণ করেছেন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। তাই তাঁরা অঢেল সাধুবাদ পাবেন।
দীর্ঘদিন হলো কবির এই স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান খবরের শিরোনামে এসেছে শুধু দুর্নীতি, বেনিয়ম, গন্ডগোল, বিতর্কের কারণে। এ বার তার ব্যতিক্রম হলো। অনেকদিন পর বিশ্বভারতীতে একটা ভালো কাজ দেখলাম আমরা। অনেকদিন পর ভালো কাজের জন্য শিরোনামে উঠে এল বিশ্বভারতী।
বলা হয়, ভারতের আর পাঁচটা রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গে না কি জাতপাতের প্রাবল্য কম। কিন্তু সেই পশ্চিমবঙ্গের সর্বক্ষেত্রেই আমরা দেখি, চট্টোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, ভট্টাচার্যদের মতো ব্রাক্ষ্মণরা বা ঘোষ, বোস, রায়, সেনের মতো কায়স্থদের রমরমা। রাজনীতি থেকে শিক্ষা, সংস্কৃতি সব জায়গাতেই উচ্চবর্ণের প্রতাপ। দলিত, আদিবাসীরা কোথায়? পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মধ্যবিত্তরা শান্তিনিকেতন গিয়ে সাঁওতাল নাচ দেখতে পছন্দ করেন, মুখে বীরসা মুন্ডাদের কথা বলেন, ব্যস ওই পর্ষন্তই। তাঁদের এগিয়ে যাওয়ার পথ পশ্চিমবঙ্গেও ততটাই কঠিন, যতটা অন্য রাজ্যে। খাতায়-কলমে সুযোগ আছে সবই, উচ্চবর্ণের প্রাধান্য সরিয়ে দলিত, আদিবাসীদের উপরে উঠে আসার লড়াইটা যে কতটা তীব্র ও তীক্ষ্ণ, তা একমাত্র তাঁরাই মর্মে মর্মে অনুভব করেন।
সেই পরিস্থিতিতে বিশ্বভারতীর মতো প্রতিষ্ঠানে আদিবাসী সাফাই কর্মীকে উপাসনা মন্দিরের আচার্য করার তাৎপর্য বিশাল। মনে হতে পারে, এটা গিমিক। প্রচার পাওয়ার উপায়। কিন্তু একবার অন্তত এই নেতিবাচক মনোভাব সরিয়ে দিন, অন্তত এটা ভাবুন, ওই আদিবাসী সাফাই কর্মীকে উপাচার্য করে ঐতিহ্যকেই আরও উজ্জ্বল করতে পেরেছেন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে আদিবাসী সাফাই কর্মীদের মনেও একটা আলো জ্বালিয়ে দিতে পেরেছেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের উপাসনা মন্দিরে আমরাও আচার্য হতে পারি, এই বোধ, এই বাস্তবতা তাঁদের আত্মবিশ্বাস অনেকটা বাড়িয়ে দিতে পারে। তাঁদের লড়াইয়ে বড় ইন্ধন যোগাতে পারে এই ঘটনা।