শান্তিনিকেতনে অশান্তি
৯ অক্টোবর ২০১৮বীরভূম জেলা পুলিশ ফের তৎপর হয়ে উঠেছে বোলপুর-শান্তিনিকেতন অঞ্চলের স্থায়ী আবাসিকের নিরাপত্তা নিয়ে৷ তার কারণ, সদ্য ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা, যেখানে এক বয়স্কা মহিলাকে ছুরির মুখে আটকে রেখে তাঁর বাড়িতে ডাকাতি করা হয়েছে৷ শান্তিনিকেতনে এমন ঘটনা এই প্রথম নয়৷ সেখানেও চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ ক্রমশ বেড়ে চলেছে৷ কিন্তু প্রবীণ নাগরিকরা, যাঁরা বয়সোচিত কারণেই বাধা দিতে অক্ষম, তাঁদের টার্গেট করার ঘটনাও ইদানীং বাড়ছে৷ মূলত দুটো কারণে৷ এক, শান্তিনিকেতনের গাছপালা ঘেরা নির্জন পরিবেশে বাড়িগুলি একটা অন্যটার থেকে একটু দূরে দূরে এবং বেশিরভাগ বাড়িই বাগান দিয়ে ঘেরা, চারদিক খোলামেলা৷ আর দ্বিতীয় কারণ, শান্তিনিকেতনের যাঁরা স্থায়ী বাসিন্দা, তাঁরা অধিকাংশই বয়স্ক৷ অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধাই একা থাকেন৷ অথবা ফাঁকা বাড়ি পড়ে থাকে স্থানীয় কেয়ারটেকারের ভরসায়৷ এই দুটি বিষয়ই নিরাপত্তার নজর থেকে অত্যন্ত বিপদজনক৷ ফলে এর আগে কলকাতায় বা সল্ট লেক অঞ্চলে একলা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ওপর যেভাবে একের পর এক হামলা এবং ডাকাতির ঘটনা ঘটছিল, সেই একই উপদ্রব শুরু হয়েছে শান্তিনিকেতনে৷
বীরভূম জেলা পুলিশ এ কারণে বাড়তি সতর্কতা নিতে শুরু করেছে৷ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বোলপুর, শ্রীনিকেতন, শান্তিনিকেতন, প্রান্তিক এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন, এমন প্রবীণ নাগরিকদের একটি ডেটাবেস তৈরি করার৷ নিয়ম করে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই প্রবীণ মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার, খোঁজখবর নেওয়ার, যাতে দুষ্কৃতিরা কোনো ফাঁকা বাড়িতে ঢুকে কোনো একলা মানুষের ওপর হামলা করার আগে দুবার ভাবে৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এর আগেও শান্তিনিকেতন এলাকায় ‘আশ্বাস' বলে একটি প্রকল্প চালু হয়েছিল, যার একই উদ্দেশ্য ছিল৷ কিন্তু নানা কারণে সেটি সফল হয়নি৷ তার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে লোকাভাব৷ পুলিশে যথেষ্ট সংখ্যক কর্মী নেই, যাঁদের নিয়মিত এই কাজে নিযুক্ত রাখা যায়৷ শান্তিনিকেতনের বাসিন্দারাও কিন্তু মনে করছেন, এই দায়িত্ব একা পুলিশ বা জেলা প্রশাসনের হতে পারে না৷ এ এক সমবেত দায়িত্ব, যাতে নাগরিকদেরও শামিল হতে হবে৷ শান্তিনিকেতনের বাগানপাড়া অঞ্চলের দীর্ঘদিনের বাসিন্দা, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান গ্রন্থাগারিক স্বপন কুমার ঘোষ যেমন ডয়চে ভেলেকে স্পষ্টই জানালেন, ‘‘এ ব্যাপারে পুলিশ প্রশাসন যে খুব নিষ্ক্রিয়, তা আমি বলব না৷ তাঁরাও তাঁদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেন৷'' স্বপনবাবুই জানালেন, প্রায় এক বছর হতে চলল, বোলপুর শহরে প্রবীণ নাগরিক যাঁরা আছেন, শ্রীনিকেতনে, শান্তিনিকেতনে, তাঁদের সঙ্গে সংযোগ রাখার জন্য একটা কেন্দ্র খোলা হয়েছে৷ রাঙামাটি হেল্প লাইন৷ কিন্তু এর আগে পুলিশেরই ‘আশ্বাস' কর্মসূচি সেভাবে সফল হয়নি৷ স্বপনবাবুর সোজা উত্তর, ‘‘আমরা যারা নাগরিক আছি, তাঁদেরকেও এটা একটু ভাবতে হবে৷ শুধু প্রশাসন, পঞ্চায়েত, পুলিশ করে দেবে, সেটা নয়, আমাদেরও তাদের সঙ্গে শামিল হতে হবে৷''
স্বপন কুমার ঘোষ নানা সম্ভাব্য ব্যবস্থার কথা বলেছেন৷ যেমন, আবাসিক অঞ্চলগুলিতে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা৷ যদি প্রত্যেকটি বাড়ির চত্বরে একটি করে জোরালো আলো লাগানো যায়, তা হলেও অনেকটা বিপদ কমবে বলে তাঁর বিশ্বাস৷ এছাড়া এলাকাবাসীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে রাতপাহারার ব্যবস্থা করার কথাও তিনি জানিয়েছেন৷ তাঁর যেখানে বাড়ি, সেই বাগানপাড়া এলাকাতে একজন রক্ষী তাঁরা নিয়োগ করেছেন৷ এছাড়া বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব যে পাহারা ব্যবস্থা আছে, সেটিকেও আরো সক্রিয় করে তোলা, শ্রীনিকেতন, প্রান্তিকের মতো জায়গায় একটি করে ফটক বসানো, এ রমক নানা কিছুর প্রস্তাব তাঁর আছে৷ এর সঙ্গে পুলিশের টহলদারি, আবাসিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলা, এগুলি তো আছেই৷
কথাপ্রসঙ্গে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন আজন্ম শান্তিনিকেতনের বাসিন্দা স্বপন কুমার ঘোষ৷ মানুষে মানুষে যোগাযোগটা আগের মতো থাকলে এই ধরনের ঘটনা এড়ানো যায়, এড়ানো যেত বলে মনে করেন তিনি৷ এক সময় একজন গিয়ে আরেকজনের বাড়ি খোঁজ নিতেন৷ এখন বয়সের কারণে অনেকেই বাড়ির বাইরে বেরোতে পারেন না৷ নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখা হয় না সবার৷ সেই সামাজিক বিচ্ছিন্নতারই সুযোগ নিচ্ছে দুষ্কৃতিরা৷