বিশ্বের নিপীড়িত নারীদের হয়ে লড়ছেন মোনিকা হাউজার
১৮ ডিসেম্বর ২০০৮স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ মোনিকা হাউজারের জন্ম হয় সুইজারল্যান্ডে৷ গত প্রায় ১৫ বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশ বা সংকটময় ও সংঘাতবহুল অঞ্চলে কাজ করে চলেছেন মোনিকা৷ হ্যাঁ, নারী ডাক্তার হিসেবেই৷ তবে তাঁর কাজ মূলত এমন নারীদের নিয়ে, যারা যৌন নিপীড়নের শিকার৷ যাদের শ্লীলতাহানি ঘটেছে দিনের পর দিন৷ কখনো বসনিয়ায়, কখনো কঙ্গোয়, কখনো সুদান, লাইবেরিয়া অথবা আফগানিস্তানে৷
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এমন নারীর শরীর, স্বাস্থ্য এবং মানসিক অবস্থা নিয়ে মাথাব্যাথা নেই কারুর৷ তাই ১৯৯২ সালে বল্কান যুদ্ধ শুরু হলে নিজের জিনিস-পত্র গোছগাছ করে বসনিয়ায় পাড়ি দেন মোনিকা৷ সে সময় তাঁর বয়েস ছিল মাত্র ৩৩ বছর৷ মোনিকা হাউজারের কথায় : সে সময় যুদ্ধ বিদ্ধস্ত বসনিয়ার অবস্থা দেখেআমি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হই৷ ক্ষুব্ধ হই সেখানকার শ্লীলতাহানির শিকার হওয়া মেয়েদের অবস্থা দেখে৷ তাদের কথা যে ভাবে সে সময়কার সংবাদপত্রগুলির প্রতিবেদনে উঠে আসে - তা দেখে আমি সত্যিই আতঙ্কিত হই৷ সংবাদমাধ্যমগুলি যেভাবে নারীদের অবস্থা তুলে ধরছিল, তাকে ধিক্কার জানাই আমি৷ সে মুহূর্তে বসনিয়ায় না গিয়ে আমি থাকতে পারি নি৷
যেমন কথা, তেমন কাজ৷ অচিরেই বসনিয়ায় একটি নারী বিষয়ক সংগঠন গড়ে তোলেন মোনিকা হাউজার৷ বিশ্ব সমাজে তিনি তুলে ধরেন সেখানকার নারীদের করুণ কাহিনী৷ তাদের দুর্দশার কথা৷ কারণ, সে সময় বিষয়টি নিয়ে কেউ-ই মুখ খুলতে রাজি ছিলেন না৷ মোনিকা জানান : সে সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেই সব নারীদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো৷ সমাজে তাদের অধিকার, তাদের শরীর স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়গুলি নিশ্চিৎ করা৷ নির্যাতিত সেই নারীদের সমাজে আবার নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল সে সময়কার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ৷ যাতে তারা আবারও সমাজের মূল ধারায় ফিরে আসতে পারেন৷
শুধু এটুকুই নয়, যৌন পীড়নের শিকার সেই সব নারীর জন্য অপরাধীদের শাস্তি দেওয়াটাও ছিল মোনিকা হাউজারের কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয়৷ তাই মোনিকা এই ধরনের ঘটনাগুলিকে দ্য হেগ শহরে অবস্থিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক আদালতে পেশ করেন৷ যেখানে বহুক্ষেত্রেই সাফল্য পান মোনিকা৷ বলেন : এটা আমাদের এবং অন্যান্য মহিলা প্রবক্তাদের সাফল্য বলা যেতে পারে৷ এ-ধরনের সাফল্য একমাত্র একত্রিত হয়ে অর্জন করা যায়৷ তবে এর পিছনে আমাদের অনমনীয়তারও একটা বড় ভূমিকা রয়েছে৷ কেন না, আমরা কখনোই হাল ছাড়ি নি৷ বরং বারবার বলেছি, এটা নারীদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ৷ এর ফলে, তাদের যারা নির্যাতন করেছে, তাদের দন্ড দান করা হচ্ছে৷ এটা একটা নৈতিকতার প্রশ্ন, সেই পুরুষদের যাতে তাদের কৃতকর্মের ফলভোগ করতে হয়, আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র-সমাজ তার ব্যবস্থা করবে৷
মোনিকার কথায়, যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশগুলিতে নারীর ধর্ষণ মানবাধিকার লংঘনেরই নামান্তর৷ আর সেই সব অগুন্তি নারীর অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া আন্তর্জাতিক সমাজের সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়৷ আর এর জন্য যে শুধু অর্থের প্রয়োজন - তা নয়৷ প্রয়োজন সহানুভূতির, প্রয়োজন সহমর্মিতার, প্রয়োজন সংবেদনশীলতার৷ বিকল্প নোবেল পুরস্কার জয়ী মোনিকা হাউজার বললেন : এই পুরস্কার বিশ্বব্যাপী মহিলাদের আরো বেশি যৌথ নীতির বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করবে৷ যাতে তাদের আন্তর্জাতিক রাজনীতির চাপে গুঁড়িয়ে না যেতে হয়৷ যাতে তারা সারা বিশ্বের নারীদের সঙ্গে জোট বাঁধতে পারে৷ অন্যদিকে, এই পুরস্কার আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও দুয়ার মুক্ত করবে বলে আমাদের আশা৷
এতো সব কাজের পিছনে, সংসারের প্রতি যত্ন নিতেও ভোলেন না মোনিকা হাউজার৷ অবশ্য স্বামী ক্লাউস পেটার ও একমাত্র সন্তানের সাহায্য ছাড়া এ-কাজ যে কখনোই সম্ভব হতো না - তা সব সময়ই স্বীকার করেন মোনিকা৷