বেতন বৈষম্য, সাংবাদিকের খবর দেবে কে?
২৯ আগস্ট ২০১৭এমন একটা সময় ছিল, পত্রিকায় কোনো সংবাদ প্রকাশ হলে তা ছড়িয়ে যেত দেশের আনাচে-কানাচে৷ নড়ে বসতো প্রশাসন, ব্যবস্থা হতো তড়িৎ গতিতে৷
সময় গড়িয়েছে, এসেছে অনলাইন সংবাদপত্র, টেলিভিশন৷ এর ফলে একদিকে যেমন সংবাদ প্রকাশের পরিমাণ বেড়েছে, ব্যস্তানুপাতিক হারে কমেছে মানুষের কাছে পৌঁছানোর হার৷ হাতেগোণা কিছু সংবাদপত্র ও টেলিভিশন ছাড়া, বাকিরা টিকে আছে কোনোরকমে৷
আর এই কোনোরকমে টিকে থাকতে গিয়ে নানা প্রশ্নের মুখে পড়েছে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা৷ সাংবাদিকরা সঠিক সংবাদ প্রকাশকে সমাজের প্রতি নিজেদের দায়িত্ব মনে করলেও, গণমাধ্যমের মালিকানা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ক্ষেত্রের ব্যবসায়ীদের হাতে৷
এই মালিকরা কি সবসময় সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করাকে নিজেদের প্রধান লক্ষ্য ভাবেন? নাকি নিজেদের ব্যবসা ও প্রভাব টিকিয়ে রাখতে নানাভাবে নিজের মালিকানার গণমাধ্যমকে কাজে লাগান?
যে কোনোভাবে প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে গিয়ে মূল অর্থনৈতিক খাঁড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পড়ে সাংবাদিকদের গলায়৷ ফলে এক্ষেত্রে বাড়ছে অর্থনৈতিক বৈষম্য৷ বেতন-ভাতা নিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠানে কথা বলতে পারছেন নিম্ন ও মধ্যম স্তরে কর্মরত সাংবাদিকরা? দেশের অর্থনীতির সাথে ভারসাম্য রেখে সঠিক প্রক্রিয়ায় কি মূল্যায়ন হচ্ছে তাঁর কাজ?
ফলে সব ছাপিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, ‘পর্যাপ্ত বেতন নিশ্চিত করা হলে কি সাংবাদিকতার মান নিশ্চিত করা সম্ভব?' ফেসবুকে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকেরা৷ এর মধ্যে যেমন দীর্ঘদিন বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করা সাংবাদিক রয়েছেন, রয়েছেন মফস্বলের সাংবাদিক, আবার মুখ খুলেছেন ভিডিও সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যমের অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজ করা কর্মীরাও৷
মোরশেদ হাসিব হাসান বলছেন, ‘‘পেটে ভাত না থাকলে, আমার জীবন মান উন্নত করার সুযোগ না থাকলে, আমার চাহিদা পূরণ না হলে, হয় আমি পেশাটি ছেড়ে দেবো, কিংবা পেশাটিকে কলুষিত করবো৷''
সাংবাদিকদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে রসিকতা করতে ছাড়েননি রাফে সাদনান আদেল৷ বলছেন, ‘‘পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার না খেলে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়, দেখা দেয় আয়রন ডেফিসিয়েন্সি এনিমিয়া৷ সাংবাদিকদের পোলাপানের নাকি এইটা বেশি হয়; মান টান কি হয় তা জানি না কো বাপু!''
সাংবাদিকদের হতাশার কথা ফুটে উঠেছে, ফয়সাল সিদ্দিকী, মুকিমুল আহসান হিমেল, শিমুল সালাহউদ্দিন, ওয়াসেক সাজ্জাদ, খাদিজাতুল কোবরা ইভার কথাতেও৷ ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে, শ্রমঘণ্টার হিসেব মাথায় না রেখে কাজ করার পরও মাস শেষে প্রাপ্য মজুরি সঠিকভাবে না পাওয়ার দুঃখ বলছেন তারা৷
একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে ভিডিও জার্নালিস্ট হিসেবে কর্মরত রাকিবুল হাসান বলছেন, মাস শেষে আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য রক্ষায় অনেকেই বাধ্য হন মূল পেশার পাশাপাশি বিকল্প অর্থ উপার্জনের উপায় খুঁজতে৷ এর ফলে সাংবাদিকতাও ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে মনে করেন তিনি৷
ভিডিও এডিটর রুমা রুমানা মনে করেন অল্প বেতনে কর্মী খুঁজতে গিয়ে অযোগ্যদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সংবাদমাধ্যম৷
দেশের গণমাধ্যমে সবচেয়ে অবহেলিত বলে মনে করা হয় তৃণমূলের সাংবাদিকদের৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বেতন কাঠামো না থাকায় অনেকেই সংসার চালাতেও হিমশিম খান৷ সবচেয়ে ভালো কাজটা প্রত্যাশা করলেও সবচেয়ে খারাপ বেতনটা সাধারণত তাঁদেরই হয়ে থাকে৷ রাজধানীর সাংবাদিকরা যেসব অল্পবিস্তর সুবিধা পান, মফস্বলে তা-ও পাওয়া যায় না৷
স্বভাবতই মফস্বলের সাংবাদিকদের ক্ষোভটাও তাই বেশি৷ কুষ্টিয়ার মিলন মাহামুদ বলছেন, ‘‘জেলা পর্যায়ের সাংবাদিকদের যা পারিশ্রমিক তাতে একজন ব্যাক্তির চলাচলেরই তো কষ্ট দায়ক পরিবারের চাহিদা মেটাতে তো হিমশিম খেতে হয়৷''
খুলনার অভিজিৎ পাল বলছেন, ‘‘সাংবাদিকদের অর্থনৈতিক দৈন্যের সুযোগ কাজে লাগায় কেউ কেউ৷ ফলে গণমাধ্যমও কলুষিত হয়ে পড়ে৷''
তেল আনতে নুন ফুরিয়ে যায় সৃষ্টিশীল কিছু করা অসম্ভব না হলেও, অনেক কঠিন বলে মনে করেন গাজীপুরের আবুল হাসান৷
কুমিল্লার দিল রুবাইয়াৎ সুরভী আর মানিকগঞ্জের মঞ্জুর রহমানের অভিযোগ সংবাদমাধ্যমের ‘বড়কর্তাদের' বিরুদ্ধে৷ তাঁরা মনে করেন, সাংবাদিকদের শুধু কাজেই লাগানো হয়, তাদের দিকটা বিবেচনায় রাখা হয় না৷
তবে আছে এর পালটা বক্তব্যও৷ সাংবাদিকদের সবসময়ই অনেক কষ্ট ও নিপীড়ন সহ্য করে কাজ করতে হয়৷ সাংবাদিকতাকে সাংবাদিকরা শুধু পেশা নয়, লাইফস্টাইল হিসেবেও গ্রহণ করে থাকেন৷ ফলে কেউ কেউ মনে করছেন, শুধু আর্থিক বিষয়টি নিশ্চিত করলেই নিশ্চিত হবে না সাংবাদিকতার মান৷
আরাফাত সিদ্দিক বলছেন, ‘‘মালিকানা ও সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার উপর৷ এ সবে বিশাল গলদ থাকলে যতই বেতন দিন ‘মান' নিশ্চিত হবে না৷'' এই ব্যর্থতার দায় তিনি চাপাচ্ছেন যারা সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করেন তাদের ওপর৷
বেশ কিছু যুক্তি দিয়ে নিজের কথা তুলে ধরেছেন জুবায়ের আহমেদ৷ অর্থনৈতিক নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ ভাবলেও তিনি মনে করেন, সাংবাদিকের মান নির্ভর করে স্কুলিংয়ের ওপর৷ আর সাংবাদিকতার মান নির্ভর করে সেই স্কুলিংয়ের শিক্ষা কতটা কাজে লাগানো যায় সেই সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশের ওপর৷
কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে? সে প্রশ্নেই আপাতত থমকে থাকছে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা৷