বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা কেমন?
২১ জুন ২০১৭২০১৫ সালের ১০ আগস্ট৷ বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে ‘আমার জীবন শঙ্কা তথা মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী থাকবেন' শিরোনামে একটি স্ট্যাটাস দেন দৈনিক বাংলা ৭১-এর সম্পাদক ও প্রকাশক প্রবীর সিকদার, সেখানে তিনি যে তিন জনের নাম প্রকাশ করেন তাঁদের একজন ছিলেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন৷ ওই লেখার কারণে ১৬ আগস্ট সন্ধ্যায় গোয়েন্দা পুলিশ সাংবাদিক প্রবীরকে তাঁদের কার্যালয়ে ধরে নিয়ে যায়৷ তখন তাঁকে আটক না করার কথা বলা হলেও রাতে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ফরিদপুরে৷ পরে জানা যায়, ফেসবুকে লেখার মাধ্যমে মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফের সুনাম ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছেন জেলার এপিপি স্বপন পাল৷ পরের দিন আদালত প্রবীর সিকদারকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়৷
<iframe src="https://www.facebook.com/plugins/video.php?href=https%3A%2F%2Fwww.facebook.com%2Fdwbengali%2Fvideos%2F10154595583615978%2F&show_text=0&width=560" width="560" height="315" style="border:none;overflow:hidden" scrolling="no" frameborder="0" allowTransparency="true" allowFullScreen="true"></iframe>
গেল ১১ জুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে ‘একটি অসুস্থ শিশু, বিচারকের ট্রাক ও একটি মামলা' শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়, যাতে মানিকগঞ্জে বিচারক মাহবুবুর রহমানের বাড়ি বদলের ট্রাকের কারণে একটি অসুস্থ শিশুকে হাসপাতালে নেওয়ার পথ রুদ্ধ হওয়ার কথা বলেন স্থানীয়রা৷ এই ঘটনা নিয়ে আদালতের এক কর্মচারী ওই শিশুর মামা এবং স্থানীয় এক সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন৷ প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করা হয়৷ পরে ওই প্রতিবেদনের কারণে প্রতিবেদক গোলাম মুজতবা ধ্রুব'র বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করা হয়৷ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম দাবি করে, যথাযথ ‘ব্যাকরণ' মেনে সংবাদ পরিবেশন করার পরও কোনো কারণ ছাড়াই এ মামলা করা হয়েছে৷
আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলার কথা এখন প্রায়ই শোনা যাচ্ছে৷ এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ১৩ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এই ধারায় মামলা হয়েছে৷ ধারাটি অস্বচ্ছ বলে এরই মধ্যে অনেক সমালোচনা আছে৷ এমনকি আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও বলেছিলেন যে, এটি পরিবর্তন করার ব্যাপারে কাজ চলছে৷ বর্তমান এই আইনের ৫৭ ধারা অনুযায়ী, কেউ অনলাইনে কোনো লেখায় বা পোস্টে কারো মানহানি হয়েছে বলে মনে করলে তিনি লেখক বা পোস্টকারীর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন৷ সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বাক বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়ে বারবারই উঠে এসেছে এই ৫৭ ধারার প্রসঙ্গ৷ বৈশ্বিক পর্যায়ে যাঁরা বাক-স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করেন, তাঁরাও বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন৷ আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের হিসেবে গেল বছর বাকস্বাধীনতার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ২ ধাপ পড়েছে৷ এখন সারাবিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬৷
এ বিষয়ে দৈনিক প্রথম আলো'র সহ-সম্পাদক মিজানুর রহমান খান ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘‘২০০৫-০৬ সালে বিএনপি জামায়াত সরকার যেসব আইন করেছে তার অনেকগুলোই বাকস্বাধীনতার পরিপন্থি৷ তার একটি এই তথ্য প্রযুক্তি আইন৷ পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার এসে সেসব আইন তো বদলায়ইনি, বরং তথ্য প্রযুক্তি আইনটির ৫৭ ধারায় যে শাস্তি তা বাড়িয়েছে৷ এ ধরণের অপরাধ জামিনযোগ্য থেকে অ-জামিনযোগ্য করেছে৷ বিভিন্ন সময়ে আইনমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রী আইনটি সংশোধনের কথা বললেও কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না সরকারের মধ্যে, যা খুবই উদ্বেগজনক৷''
এমনকি নতুন যে ডিজিটাল আইনের কথা বলা হচ্ছে, সেখানেও এই বাকস্বাধীনতার পরিপন্থি কিছু বিষয় থেকে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন মিজানুর রহমান৷ তাঁর মতে, এই ধারায় মামলা বা হয়রানির সুবিধা নিচ্ছে সরকারি দলের নেতা, কর্মী ও প্রভাবশালীরাই৷ তিনি বলেন, ‘‘৫৭ ধারা বাতিল হলেও এই ধারার বিষয়গুলো অন্য কোথাও থেকে গেলে এর সুফল পাওয়া যাবে না৷''
একই মত দ্য ডেইলি নিউ এজ-এর সম্পাদক নুরুল কবিরের৷ দেশে সাংবিধানিকভাবেই গণতান্ত্রিক কাঠামো না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে এমন একটা সরকার ব্যবস্থা আছে, যেটি সাংবিধানিকভাবেই স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা৷ সরকার প্রধান, নির্বাহী বিভাগ ও আইন ব্যবস্থার প্রধান, যা বিচার ব্যবস্থার ওপর প্রভাব বিস্তারের সামর্থ জোগায়৷ কাঠামোগতভাবেই আমরা একটি অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে আছি৷''
নুরুল কবির মনে করেন, বাক বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রাজনৈতিক কাঠামোর ওপরই নির্ভর করে৷ সরকারের সমর্থনপুষ্ট বিরোধী দল ও সরকারী দল ছাড়া আর কারো রাজনৈতিক তৎপরতা সহ্য করা হয় না৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘এমন ব্যবস্থায় শাসক শ্রেণির মাঝে যে রাজনৈতিক আকাঙ্খার তৈরি হয়, তাতে সমালোচিত হলে আইনি বা বেআইনি বাধার মুখে পড়তে হয় গণমাধ্যমকে৷''
একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলে এমন অবস্থার তৈরি হতো না বলে মনে করেন তিনি৷ কিন্তু বিএনপি বাক-স্বাধীনতা বা জনগণের সমস্যার জন্য লড়া তো বহুদূর, নিজেদের সমস্যারই সমাধান করতে পারে না বলে মত নুরুল কবিরের৷
সরকার বা রাজনৈতিক চাপ সামলানোর জন্য সংবাদমাধ্যমের অপেশাদার ব্যবস্থাকেও দায়ী করছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী৷
‘‘যে কোনো সরকারগণমাধ্যমের ওপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করে যেন তার পক্ষে লেখা হয়৷ সরকারের কর্মকর্তারা চাপ দেন, রাজনৈতিক নেতারা চাপ দেন৷ প্রশ্ন হলো সেই চাপ আপনি নেবেন, না অগ্রাহ্য করবেন'' বলছিলেন তিনি৷ তাঁর মতে, সংবাদ মাধ্যমের মালিকানাসমস্যা একটি বড় সমস্যা৷
‘‘অসৎ, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক থেকে শুরু করে সংবাদপত্র বোঝেন না এমন লোকজন এর মালিক হয়েছেন৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পাদকের চেয়ারেও বসেছেন৷ চাপটা অগ্রাহ্য করা সম্ভব হয়, তখন যখন এই ধরণের মালিকানা না থাকে৷''
ডয়চে ভেলে আয়োজিত গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামে যোগ দিতে আসা বাংলাদেশের এই সিনিয়র সাংবাদিকরা মনে করেন, সরকারের উচিত হবে বাক-স্বাধীনতার যত আইনি বাধা আছে, তা দূর করা৷ একইসঙ্গে দলীয় নেতা-কর্মী ও প্রভাবশালীদের ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করে ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা বাড়ানোর পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তাঁরা৷
এ বিষয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷