বৈশাখি শোভাযাত্রা
১০ এপ্রিল ২০১২হাতি, ঘোড়া, বাঘের সারি গোছাতে হবে৷ সাজাতে হবে সৈন্য-সামন্তের বহর৷ সেই সঙ্গে থাকতে হবে বাদ্য-বাজনা, ঢোল-করতালের বোল-ও৷ এখানেই শেষ নয়৷ রঙিন মুখোশ, বিরাট সাম্পান, বিকট জন্তু – কী থাকবে না সে শোভাযাত্রায়!
প্রস্তুতি নিয়েই আরো শোনা যাক, এবারের শোভাযাত্রার প্রস্তুতি কাজের সমন্বয়ক, চারুকলার শিক্ষার্থী নবেন্দু সাহা নব'র কাছে ৷
‘‘এবারের উৎসবের মূল থিম হচ্ছে সমুদ্র বিজয়৷ তাই, সমুদ্র বিজয়ের প্রতীকী রূপ হিসেবে শোভাযাত্রায় থাকবে ৪০ ফুট দীর্ঘ একটি সাম্পান৷ সাম্পানের উপরে থাকবে মানুষের কয়েকটি প্রতিকৃতি৷ যাদের হাতে ধরা থাকবে বাংলাদেশের পতাকা৷''
এখানেই শেষ নয়৷ নব্য আরো জানানা, ‘‘সাম্পানের আশে-পাশে থাকবে হাতি, ঘোড়ার বহর৷ থাকবে সৈন্য-সামন্তও৷ ঠিক যে রকমটা দেখা যেতো, সুলতানি আমলে যুদ্ধ বিজয়ের পর৷''
এছাড়া বাংলার বীরত্বকে প্রকাশ করার জন্য থাকবে বাঘের প্রতিকৃতি থাকবে বলেও জানান তিনি৷
বাংলার বিজয়, গৌরব, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পাশাপাশি এবারের শোভাযাত্রায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গটিও৷
রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের প্রতীক হিসেবে তৈরি করা হয়েছে দেখতে কুৎসিত, কদাকার ও ভয়ানক ধরণের কিছু প্রতিকৃতি৷ শিল্পী শিশীর ভট্টাচার্যের আকুঁনিতে প্রতিকৃতিগুলো ফুটে উঠেছে৷
পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে চারুকলা থেকে প্রথম শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয় আজ থেকে প্রায় দুই যুগ আগে৷ সে শোভাযাত্রার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন মাহবুব জামিল নামের এক স্বাপ্নিক তরুণ৷
‘‘১৯৮৬ সালে প্রথম আমরা এ ধরণের শোভাযাত্রার আয়োজন করি যশোরে, চারুপীঠ নামে একটি প্রতিষ্ঠান এর পক্ষ থেকে৷ তার পর আমি এম এ পড়তে আসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে৷ সে সময়, ১৯৮৯ সালে প্রথম মূলত আমার উদ্যোগেই ঢাকা চারুকলা থেকে আয়োজন করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রার৷''
কিন্তু কেন, কোন স্বপ্ন নিয়ে এই কাজ শুরু করেছিলেন তিনি? এই প্রশ্নের উত্তরে চারুপীঠ এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ মাহবুব জামিল বলেন, ‘‘সামাজিকায়নের একটি পথ হিসেবে আমরা বেছে নেই উৎসব উৎযাপনকে৷ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আমরা মেলার আয়োজন করি৷ যে মেলা গ্রাম ও শহরেরে জীবনের একটা মেলবন্ধন৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আর বিভিন্ন ধরণের ভিজ্যুয়াল আর্ট ফর্ম যেমন- চিত্রকর্ম, নাটক, সঙ্গীত ইত্যাদিকে মিলাবার জন্য আয়োজন করি মঙ্গল শোভাযাত্রার৷''
শুধু তাই নয়, জামিলের মতে, আমাদের মুসলিম লোক জীবন থেকে ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছিলো সংস্কৃতির ছোঁয়া৷ ‘‘হারিয়ে যাওয়া সেই সঙ্গীত, নৃত্যসহ সংস্কৃতির সকল ধারাকে লোক জীবনে ফিরিয়ে আনতেই এই শোভাযাত্রা৷''
যশোরে চারুপীঠ নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তরুণ জামিল, সে স্বপ্ন আজ অনেকটাই ছড়িয়ে গেছে৷ ঢাকা, চট্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এখন আয়োজন করা হয় শোভাযাত্রার৷ আর যশোরে তো হয়-ই৷ এবারেও যশোরে চলছে বিরাট আয়োজন৷
নাগরিক বর্ষবরণের ক্ষেত্রে দিনে দিনে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠছে মঙ্গল শোভাযাত্রা৷ তবে কিনা, ঠিক এরকম নয়, আরেকটু বড় ক্যানভাসে শোভাযাত্রার স্বপ্নটি দেখেছিলেন জামিল৷
তাঁর ভাষায়, ‘‘একটি জাতীয় উৎসবের জন্য মহাপরিকল্পনা করেছিলাম৷ সেই উৎসবে বাংলাদেশে প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী, নৃত্য শিল্পীদের অংশগ্রহণের কথা ছিলো৷ কথা ছিল বিভিন্ন চরিত্রের পোশাক পরে নাট্যকর্মীদের অংশ নেবে শোভাযাত্রায়৷ কিন্তু চারুকলার অন্য যারা আমার সঙ্গে ছিল, তারা কেউ তখন এ বিষয়ে একমত হয় নি৷ শোভাযাত্রাটিকে তারা চারুকলার বাইরে দিতে রাজি হয় নি৷''
নাগরিক জীবনে লোক সংস্কৃতির স্বপ্ন বুনে দিয়ে জামিল ফিরে গেছেন যশোরে, সেই চারুপীঠ-এ৷ যেখান থেকে তাঁর স্বপ্নের শুরু৷ আজও তিনি সেখানেই আছেন৷
যদিও জামিলের স্বপ্নের পুরোটা অনুবাদ হয় নি কিন্তু যতটুকু হয়েছে, তাই বা কম কী! চারুকলার শোভাযাত্রার কলেবর দিন দিন আরো বড় হচ্ছে৷ বাঙালি লোক জীবনের নানা উপাদান তো আছেই, সেখানে যুক্ত হচ্ছে সামাজিক, রাজনৈতিক ও জাতীয় জীবনের নানা প্রসঙ্গও৷
তাই, বলা যায়, জামিলের স্বপ্ন মরে নি৷ সেই স্বপ্নই আজও বয়ে চলছে চারুকলা পড়তে আসা নতুন প্রজন্ম৷
প্রতিবেদন: আফরোজা সোমা
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন