1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ব্যবস্থাপনায় রোল মডেল হয়েও দুর্যোগে নাকাল হওয়ার কারণ

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৭ মে ২০২২

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সুনাম থাকলেও এবার সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে৷ কেন এমন হয়?

https://p.dw.com/p/4Bxt6
ছবি: Fatima-Tuj Johora/picture alliance/ZUMAPRESS.com

বাংলাদেশে এখনো আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়া হয় বন্দরের জন্য৷ সতর্ক সংকেতগুলো সাধারণ মানুষ বোঝেন না৷ দেশের সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যায় আগাম কোনো পূর্বাভাস দিয়ে কৃষকদের ফসল রক্ষায় ব্যবস্থা নেয়া যায়নি৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ পেরেছে৷

উপকূলীয় বাঁধগুলো ভাদ্রমাসের জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায়৷ উপকুলীয় সবুজ বেষ্টনী রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে উজাড় হয়ে যাচ্ছে৷ বজ্রপাত প্রতিরোধে লাগানো তালগাছ কেতাবে আছে কিন্তু বাস্তবে নেই৷ উপকূলের ৩২০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় দুই লাখ ৫৬ হাজার মানুষ এবং প্রায় ৪৪ হাজার গবাদি প্রাণীর আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ আছে৷ কিন্তু ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে মানুষ আশ্রয় নিতে চায় না৷

আমাদের কাছে তথ্য ছিল আমরা (কৃষকদের) জানাইনি: গওহার নাঈম ওয়ারা

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নাঈম ওয়ারা বলেন, ‘‘একটি আশ্রয় কেন্দ্রে একজন মানুষের জন্য দুই বর্গফুট জায়গা বরাদ্দ৷ সেই জায়গায় একজন মানুষ কতক্ষণ থাকতে পারে৷ এখন তো ৫৬ ঘন্টা আগে আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে বলা হয়৷ নারী আছে, শিশু আছে তারা কি অতটুকু জায়গায় থাকতে পারে? ফলে তারা যায় না৷ এর ফলাফল অনেকের মৃত্যু হয় ঘূর্ণিঝড়ে৷’’

তিনি বলেন, একটি আশ্রয় কেন্দ্রের অর্থ দিয়ে ৪০টি দোতলা বাড়ি করা সম্ভব নীচতলা ফাঁকা রেখে ৷ কিন্তু সেটা করা হয়নি৷ তাই অবকাঠামো থাকলেও দুযোর্গে কাজে লাগে না৷

বাংলাদেশে কৃষক ও কৃষিকে সামনে রেখে কোনো আবহাওয়ার পূর্বভাস দেয়া হয় না৷ কখন বৃষ্টি হবে, কখন পানি বাড়বে এগুলো কৃষক জানেন না৷ ফলে তার ফসল ডুবে যায়, বাড়ি ডুবে যায়, ঢলে সব শেষ হয়ে যায়৷ গওহার নাঈম ওয়ারা বলেন, ‘‘শুধু যদি এবার কৃষকদের জানানো হতো যে, অমুক তারিখে বৃষ্টি হবে, অমুক তারিখে পানি বাড়বে, তাহলে কৃষকদের ধান নষ্ট হতো না৷ আমাদের কাছে তথ্য ছিল, আমরা জানাইনি৷ পশ্চিম বাংলা কৃষকরা ধান রক্ষা করতে পেরেছেন৷ একই জায়গা থেকে তথ্য পেয়েও আমরা পারিনি৷’’

বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রশংসনীয় সফল্য অর্জন করলেও আরো অনেক দূর যেতে হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা৷ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম৷ চলতি দশকে বাংলাদেশের ১১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষ দুর্যোগের শিকার হয়েছেন৷

গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স বলছে, বাংলাদেশে গত ২০ বছরে ১৮৫টি আবহাওয়াজনিত তীব্র দুর্যোগ সংঘটিত হয়েছে৷ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৩.৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের৷ আর শুধু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ বিপদাপন্নতায় পৃথিবীতে বাংলাদেশ সপ্তম অবস্থানে রয়েছে৷

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে দুর্যোগ হিসেবে সামনে এসেছে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু৷ এছাড়া ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যেও রয়েছে বাংলাদেশ৷ বাংলাদেশে বছরে এখন প্রায় তিনশ' মানুষ বজ্রপাতে মারা যান৷ আর এই বজ্রপাত ঠেকাতে সারা দেশে তালগাছ লাগানোর প্রকল্প নেয়া হয়েছিল৷ এখন ৩৮ লাখ তালগাছ লাগানোর প্রকল্প বাতিল করে এখন বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে৷

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস-এর প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন বলেন, ‘‘আসলে তালগাছ বিষয় নয়, আমাদের দরকার উঁচু গাছ৷ আমরা নিজেরাই গাছ কেটে ফেলেছি৷ নিজেরাই নিজেদের বিপর্যয় ডেকে এনেছি৷ আর তাল গাছ তো সব জায়গায় লাগানো যাবে না৷ শহরে তালগাছ লাগাবেন কিভাবে?’’

তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ এখন ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা৷ সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলেও ঢাকা শহরের অধিকাংশ ভবন ধ্বসে পড়বে৷ কারণ, বিল্ডিং কোডে এখন ভূমিকম্প সহনীয় শর্ত রাখা হলেও এর আগে তো অধিকাংশ ভবন তৈরি হয়েছে৷’’

সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলেও ঢাকা শহরের অধিকাংশ ভবন ধ্বসে পড়বে: ড. খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন

এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কিছু বিষয় আছে, আগে থেকে আঁচ করা যায় না ৷ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷ কিন্তু এসব মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন তিনি৷

বাংলাদেশে সব মিলিয়ে চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি বাঁধ আছে৷ কিন্তু এবারের হাওরের বন্যায় বাঁধ টেকেনি৷ আর ভাদ্র মাসের পানির চাপ নিতে পারে না অধিকাংশ বাঁধ৷ প্রতি বছরই বাঁধ নির্মাণের পিছনে শত শত কোটি টাকা অপচয় হয়৷ খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন বলেন, ‘‘এই বালুর বাঁধগুলো আসলে টেকসই নয়৷ পানির ঢল এরা ঠেকাতে পারে না৷’’

এই বাঁধ নির্মাণে স্থানীয় মানুষের অংশগ্রণ নেই৷ তাদের প্রয়োজনীয়তার কথাও বিবেচনায় নেয়া হয়নি৷
উপকূলীয় এলাকায় সবুজ বেষ্টনী প্রকল্পের শতকরা ৫০ ভাগ গাছের এখন আর অস্তিত্ব খূঁজে পাওয়া যাবে না৷ রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে সেই গাছগুলো হাওয়া হয়ে গেছে৷ ফলে ৭৭৫ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা লবণাক্ততা ও ঝড় জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে৷ গওহার নাঈম ওয়ারা বলেন, ‘‘কী গাছ লাগাতে হয় তা-ও আমরা জানি না৷ আর গাছ লাগানোর পর আমরা খোঁজও রাখি না৷’’

সংকেত আরো সহজ করার দরকার আছে: এ এইচ এম বজলুর রহমান

কৃষি অর্থনীতির এই দেশে দুর্যোগবার্তা এখনো কৃষি ও কৃষককেন্দ্রিক নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কম্যুনিকেশন (বিএনএনআরনি)-র প্রধান এ এইচ এম বজলুর রহমান৷

আবহাওয়ার ৫, ৬, ৭ সতর্ক বার্তা যে একই সতর্কতার তা কি আমরা জানি? তাহলে কৃষক জানবে কীভাবে? এটা কৃষকের জন্য নয়, বন্দরের জন্য৷ আর আবহাওয়ার এই তথ্য কৃষি অধিদপ্তর বা মন্ত্রনালয়ের অধীনে নয়৷ গত ১০ বছরের বৃষ্টিপাতের তথ্য চাইলে গওহার নাঈম ওয়ারাকে ‘রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য’ বলে দেয়া হয়নি বলে জানান তিনি৷ কিন্তু ভারতে এই তথ্য উন্মুক্ত৷

বজলুর রহমান বলেন, ‘‘এখন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ আবহাওয়ার সতর্ক বার্তার ব্যাপারে আগের চেয়ে সচেতন হয়েছে৷ কিন্তু ভারত থেকে যে পানি আসে বা যে ঢল হয়, তা নিয়ে আগাম কিছু জানতে পারে না উত্তরাঞ্চলের মানুষ৷ আর সংকেত আরো সহজ করার দরকার আছে৷’’

তার কথা, কখন বৃষ্টি হবে, কখন পানির ঢল আসবে, কখন পানি বাড়বে- এই তথ্যগুলো পাওয়া গেলে কৃষক ও সাধারণ মানুষ অনেক বড় বড় দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতো৷