ব্রেক্সিটের পরিণতি
২৪ জুন ২০১৬এই ফলাফল সবার জন্যই একটা বিপর্যয়৷ এই সিদ্ধান্ত শুধু পরাজয়ের গ্লানি এনে দিয়েছে৷ ব্রেক্সিটপন্থিরা নিজেদের স্বাধীন মনে করতে পারেন৷ কিন্তু তাঁরা দ্রুত বুঝতে পারবেন, যে সেই স্বাধীনতা মোটেই বাস্তবসম্মত নয়৷ দেশ আরও দরিদ্র হয়ে পড়বে৷ তার চেয়েও জরুরি বিষয় হলো, ব্রিটেনের অখণ্ডতা আর না-ও বজায় থাকতে পারে, কারণ, স্কটল্যান্ডের বেশিরভাগ মানুষ ইইউ-তে থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছেন৷ ফলে তাঁরা ব্রিটেন থেকে বিচ্ছিন্ন হবার সিদ্ধান্তও নিতে পারেন৷ এক ঐক্যবদ্ধ আয়ারল্যান্ডের ডাকও জোরালো হয়ে উঠতে পারে, কারণ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বহির্সীমানা এবার আয়ারল্যান্ডের মধ্য দিয়ে আঁকা হবে৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাকি অংশেও চরম পরিণতি হতে পারে৷ ইইউ তহবিলে অর্থ দিয়ে আসছে, এমন এক সদস্য কমে যাবে৷ পররাষ্ট্র নীতি, কূটনীতি ও সামরিক শক্তির ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য দেশের অভাব টের পাওয়া যাবে৷ এমন এক রাষ্ট্র আর সদস্য থাকবে না, যা ইইউ-কে বাকি বিশ্বের কাছে আরও উন্মুক্ত, প্রতিযোগিতার বাজারে আরও উপযুক্ত করে তুলেছিল৷ বিশেষ করে জার্মানি ব্রিটেনের অভাব বেশ অনুভব করবে৷ মনে রাখতে হবে যে, এর মধ্যে অনেক দেশই ইইউ-কে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়৷ বল্গাহীন সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে রাশ টানার প্রয়োজনীয়তা তাদের কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ লন্ডন ও বার্লিন এতকাল এই প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ ছিল৷ এবার তাদের মধ্যে একটি সহযোগী দেশ চলে গেল৷
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি দেখা যাবে রাজনৈতিক স্তরে, যা নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন হবে৷ ব্রিটেনের দৃষ্টান্ত অন্যরাও অনুসরণ করতে পারে৷ তার মানে এই নয় যে, আরও দেশ ইইউ সদস্যপদ ছেড়ে দেবে৷ কিন্তু তারা এমন গণভোট আয়োজনের হুমকি দিতে পারে এবং ব্রিটেনের মতো প্রথমে নানা রকম ছাড় ও নিয়মের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আদায় করে নিতে পারে৷ তখন এমন এক ইইউ অবশিষ্ট থাকবে, যেখানে সবাই তার পছন্দমতো বিধিনিয়ম বেছে নেবে এবং কোনো বিষয়ে আর দায়বদ্ধ থাকবে না৷ সে ক্ষেত্রে এই রাষ্ট্রজোট বিশ্বমঞ্চে আর গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে স্বীকৃতি পাবে না৷
ইউরোপের বাড়তি সুবিধা কী?
ব্রেক্সিট-এর সিদ্ধান্তের পর ইউরোপে অনেকেই ব্রিটেনকে উচিত শিক্ষা দিতে উদ্যত হয়ে পড়েছে৷ তাদের যুক্তি, একবার বেরিয়ে গেলে আর কোনো খাতির নয়৷ আর কোনোরকম ছাড় দেবার প্রশ্নই ওঠে না৷ বরং এই দৃষ্টান্ত কাজে লাগিয়ে সমমনস্ক বাকি দেশগুলিকে দেখিয়ে দেওয়া হবে, একবার পরিত্যাগ করলে তার কোনো ক্ষমা নেই৷ ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট জঁ ক্লোদ ইয়ুংকার এমনই ইঙ্গিত দিয়েছেন৷ মানবিক স্তরে এমন ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বোঝা কঠিন নয়৷ কিন্তু এতে আখেরে নিজেদেরই ক্ষতি হবে৷
যারা প্রতিশোধস্পৃহায় উন্মত্ত হয়ে উঠছে, তারা দেখতে পাচ্ছে না যে, ইউরোপের অনেক দেশেই ইইউ-র বিরুদ্ধে বৈরি মনোভাব কোন মাত্রায় বেড়ে চলেছে৷ হুমকির মাধ্যমে পরিবেশ আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠবে৷ এর বদলে স্নায়ু ঠান্ডা করে ব্রিটেনের সঙ্গে নতুন করে সেতুবন্ধ গড়ে তোলা উচিত৷ অবশ্যই সেই সম্পর্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদের বিকল্প হতে পারেনা৷ কিন্তু ‘এসপার-ওসপার'-এর রাজনীতি এ ক্ষেত্রে মোটেই সহায়ক হবে না৷
ঘর সামলাতে ইইউ'রও আত্মসমালোচনার পথে চলা উচিত৷ একমাত্র ইউরোপীয় সমন্বয় প্রক্রিয়া আরও জোরদার করলে তবেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে – ব্রাসেলসের এই মন্ত্র নাগরিকদের কাছে আর যথেষ্ট নয়৷ শরণার্থী সংকট তার একটি উদাহরণ৷ অনেকের কাছেই এটাই ইউরোপ মহাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ৷ বিশেষ করে জার্মানি ইউরোপীয় সমাধানসূত্র দাবি করে অনির্দিষ্ট সংখ্যক শরণার্থী ইউরোপ জুড়ে ভাগ করে দেবার উদ্যোগ নিয়েছিল৷ অন্যদিকে অনেক দেশ তাদের জন্য সীমানা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল৷ রাষ্ট্রীয় ঋণ সংকটের ‘ইউরোপীয় সমাধানসূত্র' ঐক্যের বদলে আরও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে৷ ধনী দেশগুলির মনে হয়েছে, তাদের শোষণ করা হচ্ছে৷ অন্যদিকে দরিদ্র দেশগুলির মনে হয়েছে, তাদের উপর অনেক সিদ্ধান্ত উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে৷
ইউরোপীয় সহযোগিতার বাড়তি সুবিধাগুলি ভবিষ্যতে প্রতিটি ক্ষেত্রে আরও যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে বলতে হবে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নকে শুধু শান্তির প্রকল্প হিসেবে তুলে ধরে বাকি সব প্রশ্ন এড়িয়ে গেলে চলবে না৷
ব্রিটেনের সিদ্ধান্ত সত্যি দুঃস্বপ্নের মতো৷ তবে এটাই ছিল নিদ্রাভঙ্গের জন্য সবচেয়ে জোরালো ডাক৷ এই মুহূর্তে প্রয়োজন নিষ্ঠুর আত্মসমালোচনা৷ ভবিষ্যতে সবাই মিলে যা কিছু হাসিল করতে চাই, তাও ভালোভাবে ভেবে দেখতে হবে৷
আপনি কি লেখকের সঙ্গে একমত? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷