দ্য বব্স প্রতিযোগিতায় বাংলা ভাষার সাফল্য
২ মে ২০১৬ডয়চে ভেলের দ্য বব্স প্রতিযোগিতায় এ বছর চারটি ক্যাটাগরিতে জুরি অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়েছে৷ সোমবার বার্লিনে এক সংবাদ সম্মেলনে বব্সের জুরিমণ্ডলী চূড়ান্ত বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন৷ প্রতিযোগিতার ‘সিটিজেন জার্নালিজম' বা নাগরিক সাংবাদিকতা বিভাগে পুরস্কার জিতেছে ব্লগার হত্যা নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্র ‘‘রেজর'স এজ৷'' বাংলাদেশে মুক্তমনাদের উপর ক্রমাগত হামলা নিয়ে তৈরি ভিডিও তথ্যচিত্রটি ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলেছে৷
‘নাস্তিকের ধর্মকথা' ছদ্মনামে ব্লগ লেখা একজন ব্লগার তথ্যচিত্রটি তৈরি করেছেন৷ দ্য বব্স অ্যাওয়ার্ড জেতায় উচ্ছ্বসিত এই ব্লগার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের ‘‘রেজর'স এজ'' ডকুমেন্টারিটি সিটিজেন জার্নালিজম ক্যাটেগরিতে বব্স অ্যাওয়ার্ডের জন্যে নির্বাচিত হওয়ায় আমরা আনন্দিত৷ এই কাজটির সাথে যুক্ত সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই৷''
হিটলিস্টে থাকা এক ব্লগারের তৈরি তথ্যচিত্র
নাস্তিকের ধর্মকর্থা'র নাম ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের ‘হিটলিস্ট'এ একাধিকবার এসেছে৷ জীবন বাঁচাতে তাই বেশ কিছুদিন আত্মগোপনে থেকেছেন তিনি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা৷ বর্তমানে ইউরোপের একটি দেশে সপরিবারে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা এই ব্লগার বলেন, ‘‘ডকুমেন্টারিটি আমাদের কাছে, কেবলই একটি ডকুমেন্টারি বা শিল্প প্রচেষ্টা নয়, বরং অ্যাক্টিভিজমের মাধ্যম৷ বর্তমানে বাংলাদেশে যেভাবে একের পর এক মুক্তমনা, নাস্তিক, সেক্যুলার লেখক, ব্লগার, প্রকাশক হত্যার মহোৎসব শুরু হয়েছে, সেই প্রেক্ষাপটকে আমরা তুলে ধরতে চেয়েছি এর মাধ্যমে৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমরা বিশ্বকে দেখাতে চেয়েছি প্রথমত, কী ঘটছে বাংলাদেশে? দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন হিটলিস্টে থাকা ব্লগারদের কী অবস্থা? কেমন আছে তারা? তৃতীয়ত, আমাদের রাজনীতিবিদদের ভূমিকা কী? এবং চতুর্থত, ইতোমধ্যেই আমরা যাদের হারিয়েছি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং সবাইকে বলা, এ ভীষণ ক্ষতি৷ আমরা আর একজনকেও হারাতে চাই না৷''
বাড়ছে হত্যার পরিধি, নীরব সরকার
বাংলাদেশে গতবছর চার মুক্তমনা ব্লগার এবং এক প্রকাশক খুন হন৷ একটি উগ্র ইসলামপন্থি গোষ্ঠী এসব হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷ আর গতমাসে একাধিক হামলায় খুন হয়েছেন তিনজন অ্যাক্টিভিস্ট, একজন হিন্দু এবং একজন মুক্তমনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক৷ ব্লগার নাস্তিকের ধর্মকথা এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘এপ্রিলের শুরু থেকে বাংলাদেশে জঙ্গিরা প্রবলভাবে আক্রমণ শুরু করেছে৷ মুক্তমনা, নাস্তিক লেখক-ব্লগারেই তারা সীমাবদ্ধ নেই, তারা সমকামী আন্দোলনের কর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, হিন্দু পুরোহিত, ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান, শিয়া ইমাম, সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতা, বিদেশি জনগণ সকলকে তাদের আঘাতের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘সরকার এই ঘটনাগুলোর তদন্তকার্যে, খুনিদের ধরতে ও দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে আশ্চর্যজনকভাবে নিশ্চুপ ও নিষ্ক্রিয় রয়েছে, বরং আক্রান্তদের দোষারোপ করা, ‘ইসলামিক স্টেট,' আল-কায়দা প্রভৃতি জঙ্গি গোষ্ঠীর উপস্থিতির কথা অস্বীকার করা, এবং নানারকম দায়িত্বহীন ও অসংলগ্ন কথাবার্তা বলা – এ কাজগুলো নিষ্ঠার সাথে করে চলেছে৷''
‘‘বিভিন্ন বক্তব্য যেমন ‘ব্লগারদের আজেবাজে কথার জন্যে যদি কোনো অঘটন ঘটে, তার জন্যে সরকার কোনো দায়িত্ব নিবে না,' ‘সীমা লঙ্ঘন করা যাবে না,' ‘আমাদের সমাজে সমকামিতা মানানসই নয়,' ‘পুলিশ ঘরে ঘরে পাহারা দিতে পারবে না' ইত্যাদি বাস্তবে খুনি জঙ্গিদের পরবর্তী আক্রমণের জন্যে ভীষণ উৎসাহিত করছে'', বলে মনে করেন নাস্তিকের ধর্মকথা৷
‘পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে'
ডয়চে ভেলের দ্য বব্স প্রতিযোগিতায় চলতি বছর বাংলা ভাষার বিচারক ছিলেন ব্লগার বন্যা আহমেদ৷ গতবছর ঢাকায় মৌলবাদীদের হামলায় গুরুতর আহত এই ব্লগার বার্লিনে জুরিমণ্ডলীর বৈঠকে বাংলা ভাষার বিভিন্ন প্রকল্প তুলে ধরেন৷ ‘‘রেজর'স এজ'' তথ্যচিত্রকে বিজয়ী ঘোষণার মাধ্যমে কার্যত পরপর দু'বার বাংলা ব্লগারদের কাজের স্বীকৃতি দিচ্ছে দ্য বব্স৷ গত বছর এই অ্যাওয়ার্ড জয় করেছিল ঢাকায় নিহত লেখক অভিজিৎ রায়ের মুক্তমনা ব্লগ৷
‘‘পরপর দু'বছর বাংলাদেশের ব্লগারদের প্রকল্পকে স্বীকৃতি দেয়ার অর্থ হচ্ছে সেখানকার পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি৷ বরং অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে৷ গত কয়েকদিনে চারটি চাপাতি হামলার ঘটনা ঘটেছে৷ মুক্তমনা অ্যাক্টিভিস্ট, লেখক, ব্লগার, শিক্ষক, সংখ্যালঘু – কেউই দেশটির কোথাও আর নিরাপদে নেই'', বলেন বন্যা আহমেদ৷
নাস্তিকের ধর্মকথা মনে করেন, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে গোটা বিশ্বের মানুষকে সচেতন করার সময় এসেছে৷ তিনি বলেন, ‘‘দ্য বব্স অ্যাওয়ার্ডের জন্য আমাদের তথ্যচিত্র নির্বাচিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার পথ আরো সুগম হলো৷ আমরা মনে করি, এর মাধ্যমে বাস্তবে বাংলাদেশের জনগণের ধর্ম, বিশ্বাস, মতপ্রকাশ ও চিন্তার স্বাধীনতার যে সংগ্রাম, সেই সংগ্রামে বব্স কর্তৃপক্ষ শামিল হলেন৷ তাদেরকে সে কারণে আমরা বাংলাদেশের সংগ্রামী মুক্তমনা লেখক, ব্লগার, প্রকাশকদের পক্ষ থেকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জানাই৷''