ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত নতুন উদ্যোগ
১২ ডিসেম্বর ২০১৭গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠক করেন৷ বাংলাদেশের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যে পাঁচটি রাজ্যের সীমান্ত রয়েছে, সেখান দিয়েই কার্যত চলছে অবাধে চোরাচালান, রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ, গবাদি পশু পাচার, জাল নোটের আনাগোনা, এমনকি জঙ্গি অনুপ্রবেশের মতো ঘটনাও৷ এ সব যেন সেসব এলাকায় নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ বলা বাহুল্য, ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী বিএসএফ-এর চোখ এড়িয়ে৷ যদিও সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর কর্তাব্যক্তি কে. কে. শর্মা এ কথা অস্বীকার করে বলেন, তাঁর বাহিনী সদা সতর্ক৷ গত মাসেই ৮৭ জন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়ে, যার মধ্যে ৭৬ জনকে ফেরত পাঠানো হয়৷
উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে স্থির হয়, পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে গড়ে তোলা হবে রাজ্যগুলির সঙ্গে বিএসএফ, গোয়েন্দা বিভাগসহ কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির সুষ্ঠু সমন্বয়৷ বৈঠকের পর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সমন্বয়ের ভিত্তিতে সীমান্তে নজরদারি বাড়াতে গঠন করা হবে ‘বর্ডার প্রোটেকশন গ্রিড' বা বিপিজি, যাতে সীমান্ত নিরাপত্তায় কোনো ফাঁক না থাকে৷ তিনি বলেন, বর্ডার প্রোটেকশন গ্রিড-এর কাজকর্ম ঠিকমত হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য রাজ্যস্তরে গঠন করা হবে ‘স্ট্যান্ডিং কমিটি'৷ তাতে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির মুখ্য সচিবরা ছাড়াও থাকবেন কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা৷
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরণ রিজিজু, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়, আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোওয়াল এবং মিজোরামের মুখ্য়মন্ত্রী লালথানওয়ালা৷ ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রীরা অবশ্য অনুপস্থিত ছিলেন৷ এছাড়া বৈঠকে ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান এবং বিএসএফ-এর মহাঅধিকর্তা৷ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং-এর কথায়, ভারতের পাঁচটি রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তেরদৈর্ঘ্য ৪০৯৬ কিলোমিটার৷ এর মধ্যে ৩০০৬ কিলোমিটারে রয়েছে কাঁটাতারের বেড়া৷ বাকি ১০৯০ কিলোমিটারের মধ্যে ৪০৬ কিলোমিটার ভৌগলিক কারণে বেড়া দেওয়া সম্ভব নয়৷ ঐ অংশে নজরদারির জন্য সেন্সরের মতো বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে৷ সীমান্ত চৌকি এবং আউটপোস্ট আরও বাড়ানো দরকার, যেহেতু অনুপ্রবেশ আটকানো সহজ নয়৷ তার ওপর একবার এ দেশে ঢুকে পড়লে তাদের ফেরত পাঠানোও সহজ নয়৷ তাই যাতে ঢুকতে না পারে তার জন্য সব ফাঁকফোকর আগে বন্ধ করা জরুরি৷
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র ন্ত্রী মনে করে, জঙ্গি কার্যকলাপ এবং চোরাচালান প্রতিরোধে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান ব্যবস্থা আরও সুষ্ঠু হওয়া দরকার৷ তবে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের সিংহভাগ, অর্থাৎ ২২১৭ কিলোমিটার পশ্চিমবঙ্গে৷ তাই দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে রাজ্যগুলিকে সহযোগিতা করার অনুরোধ করেন তিনি৷ সীমান্ত চৌকি নির্মাণে জমি সমস্যার কথা উঠলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় জানান, সীমান্ত চৌকি বা আউটপোস্ট তৈরির জন্য গ্রামবাসীদের কাছ থেকে জোর করে জমি নেবার পক্ষপাতি নন তিনি৷ নিতে গেলে তাঁদের বুঝিয়ে-সুঝিয়েই নিতে হবে৷ আর রাজ্যের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের আর্থিক বঞ্চনার অভিযোগ ইতিবাচক দৃষ্টিতে বিচার-বিবেচনার আশ্বাস দেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং৷
এই প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান ও অবৈধ অনুপ্রবেশ রুখতে রাজ্য সরকারেরপ্রত্যক্ষ সহযোগিতা কতটা জরুরি জানতে চাইলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমন কল্যাণ লাহিড়ি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার মনে হয়, প্রাথমিকভাবে ভারতের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের আওতায় পড়ে৷ এর জন্য একটা ‘সিকিউরিটি পলিসি' দরকার৷ পাশাপাশি দরকার সীমান্ত ‘প্ল্যানিং'৷ যেসব প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক আছে, সেখানে বিকল্প বৈধ উপায় বের করতে হবে৷ তাহলে চোরাচালান, জঙ্গিদের অবৈধ অনুপ্রবেশ অনেকটাই বন্ধ করা সম্ভব৷ এছাড়া সড়ক যোগাযোগ জোরদার করা এবং নজরদারি আরও বাড়ানো দরকার সন্দেহ নেই৷ তবেই এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব৷ দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই৷ কেন্দ্রীয় সরকারকে তাই আঞ্চলিক স্তরের মধ্য দিয়েই যেতে হবে৷ সেক্ষেত্রে মমতা বন্দোপাধ্যায় সরকারের উচিত সহযোগিতার হাত বাড়ানো৷ ভুলে গেলে চলবে না, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে জঙ্গি কার্যকলার দমনে বাংলাদেশ যথেষ্ট সহযোগিতা করেছিল৷''
অধ্যাপক লাহিড়ির মতে, বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত হাট বন্ধ করা যাবে না, বর্ডারও ‘সিল' করাও সম্ভব নয়৷ তবে দেশের বৃহত্তর নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচিত এখনই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া৷ তাঁর কথায়, ‘‘রাজ্য সরকার যদি আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা না বোঝে, সেক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের আপত্তি অগ্রাহ্য করার সাংবিধানিক ক্ষমতা কেন্দ্রের আছে৷''