ভারতে কুসংস্কার
২২ আগস্ট ২০১৩কোনটা সংস্কার কোনটা কুসংস্কার বা কোনটা বিশ্বাস আর কোনটা অন্ধবিশ্বাস – এটা চিহ্নিত করা খড়ের গাদায় সুঁচ খোঁজার মতো৷ সেটা খোঁজার চেষ্টা করতে গিয়ে এক বিতর্ক জালে জড়িয়ে প্রাণ দিতে হলো ৬৫ বছর বয়সি ডা. নরেন্দ্র দাভোলকরকে৷ ইনি চিকিৎসকের পেশা ছেড়ে গত ১২ বছর ধরে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন৷ লাগাতার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যান অন্ধবিশ্বাস-বিরোধী বিল মহারাষ্ট্র বিধানসভায় পাশ করানোর৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হননি তিনি৷
ডা. দাভোলকরের বক্তব্য ছিল, তিনি ধর্মবিশ্বাস বা ঈশ্বরবিশ্বাসের বিরোধী নন৷ কিন্তু এই বিশ্বাসের কালোবাজারি করে যাঁরা মানুষকে ঠকান, শোষণ করেন, তাঁদের সম্পর্কে সমাজকে সচেতন করাই তাঁর লক্ষ্য৷ এমন অনেক তথাকথিত সাধুবাবা, তান্ত্রিক আছেন যাঁরা নানা ছলচাতুরি ও কালো ম্যাজিকের ব্যবসা ফেঁদে দিব্যি থাকেন৷
তাঁদের মাথায় করে রাখেন সাধারণ মানুষ থেকে রাজনীতিক, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, এমন কী মিডিয়া পর্যন্ত৷ চন্দ্রস্বামী থেকে ধীরেন ব্রম্মচারির মতো লোক ‘‘গডম্যান কাল্ট'' দিয়ে ভারতের রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিলেন৷ এর সঙ্গে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কোনো প্রশ্ন নেই৷ আছে স্রেফ অন্ধবিশ্বাস৷ সারা পৃথিবী জুড়েই এসব জিনিস চলছে৷ সাধারণ অশিক্ষিত, আধাশিক্ষিত গ্রামগঞ্জের মানুষকে শোষণের হাত থেকে বাঁচাতে তাই ডা. দাভোলকর উপযুক্ত আইন চেয়েছিলেন৷
যুক্তিবাদী হিসেবে ডা. দাভোলকর মনে করতেন, হিন্দু নারীরা নানা উপলক্ষ্যে দিনের পর দিন উপবাস পালন করতে গিয়ে রক্তাল্পতার শিকার হন৷ বিয়ে উপলক্ষ্যে প্রতি বছর টন টন আহার্যের অপচয় হয়৷ সেটা গরিবদুঃখীদের মধ্যে বিলি করা যায়৷ বিলি করলে উপকার হতো৷ দেব-দেবীর মূর্তি, স্ট্যাচু সাধারণত তৈরি হয় ‘প্লাস্টার অফ প্যারিস' দিয়ে৷ সেটা শেষ পর্যন্ত বিসর্জন দেয়া হয় নদী বা পুকুরে৷ তাতে হয় জলদূষণ৷
কলকাতার ‘সেন্টার ফর সোশ্যাল স্টাডিজ'-এর অধ্যাপক বুদ্ধদেব ঘোষ মনে করেন, প্রত্যেকেই তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন, যদি সেটা সমাজের বা অন্য কারোর ক্ষতির কারণ না হয়৷ সেটা যেন মানবাধিকার লঙ্ঘন না করে৷ সেটা যেন অমানবিক না হয়৷ যেমন, গ্রামাঞ্চলে কোনো নারীকে ডাইনির অপবাদ দিয়ে তাঁর ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়৷ গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়৷ শিক্ষা ও বিজ্ঞানচেতনার অভাবে এমনি অসংখ্য কুসংস্কার প্রচলিত সমাজে৷ যেমন, ডাইনিবিদ্যা, বান মারা, ঝাঁড়ফুক, হাঁচি, টিকটিকি, তেঁতুল গাছের ভূত, অমবস্যার রাতে ভূত বের হয়, কালো বেড়াল রাস্তা কাটলে অশুভ, যাত্রাকালে ময়ূর দেখলে শুভ ইত্যাদি৷ এটা শুধু হিন্দু সমাজেই আবদ্ধ নয়, মুসলিম সমাজে কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাস আরো ব্যাপক ও কঠোর বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে৷
এর সঙ্গে ঈশ্বর বিশ্বাসের কোনো সম্পর্ক নেই, ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথোপকথনে একথা বললেন সমাজবিজ্ঞানী বুদ্ধদেব ঘোষ৷ তার মানে এই নয় যে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের দরকার নেই৷ আন্দোলন করতে হবে যেমন করেছিলেন রামমোহন রায় সতীদাহের বিরুদ্ধে, বিদ্যাসাগর করেছিলেন বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে৷