গৃহকর্মীদের শ্রমিকের স্বীকৃতি?
৯ নভেম্বর ২০১৭অন্যান্য পেশার মতো মাতৃত্বকালীন সুবিধা আইন, ন্যূনতম বেতন আইনের আওতায় আসেন না ভারতের অসংখ্য গৃহকর্মীরা৷ দেশে বেশ কয়েকটি শ্রম আইন থাকলেও কেনোওটিতেই গৃহকর্মীদের সুরক্ষার কথা বলা নেই৷ এদেশে নিয়োগকারীর ইচ্ছায় গৃহকর্মী নিযুক্ত হন৷ পছন্দ না হলে নিয়োগ কর্তার ইচ্ছাতেই ছাঁটাই হন৷ কোনো সরকারি নিয়ম বা আইনের বালাইটুকুও নেই৷
পরিচারক অথবা পরিচারিকাদের ‘অতিকষ্টে' কর্মী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, এমন দু'টি আইন অবশ্য ভারতে আছে৷ যার মধ্যে একটি হলো, ‘অসংগঠিত কর্মীদের সামাদিক সুরক্ষা আইন – ২০০৮' এবং ‘কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ আইন — ২০১৩'৷ আইন হলেও প্রথমটি একটি সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প৷ দ্বিতীয়টি কর্মরত মহিলাদের যৌন হয়রানি রোখার আইন৷ আইনি সুরক্ষা তো দূর, কোথাও গৃহকর্মীদের ‘শ্রমিক' অথবা ‘কর্মী' হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার উল্লেখ নেই৷
পশ্চিমবঙ্গের গৃহকর্মীদের দাবি আদায়ে লড়ে চলেছে সারা বাংলা পরিচারিকা সমিতি৷ সদস্য সংখ্যা ৩০ হাজার৷ সংগঠনের সম্পাদিকা পার্বতী পাল একাধিকবার আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন৷ জাতীয় পরিস্থিতি তাঁর নখদর্পনে৷ পার্বতী দেবীর কথায়, ‘‘গৃহকর্মীদের পেশায় মহিলাদের সংখ্যাই বেশি৷ বেকারত্বের সংখ্যা যতবেশি বাড়ছে, মেয়েরা তত বেশি পরিচারিকার কাজে যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছেন৷ ন্যাহ্য দাবি আদায়ে ২০০০ সাল থেকে আন্দোলন চালাচ্ছি৷ কেন্দ্র সরকার এখন যেটা প্রচার করছে, ২০০৯ সাল থেকে তার খসড়া প্রস্তাব তৈরি হচ্ছিল৷ আমাদের দাবি আমরা সরকারকে জানিয়েছি৷ মাসিক ১৮,০০০ টাকা বেতনের দাবি জানানো হয়েছে৷ সেইসঙ্গে সপ্তাহে একদিন ছুটি দিতে হবে৷ মাতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা করতে হবে৷ ঐ সময়ে সরকারকে বেতনের বন্দোবস্ত করতে হবে৷ এছাড়াও পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে হবে৷ রাজ্যে আমাদের আন্দোলনের জেরে কয়েকটি জায়গায় এই দাবিগুলির কয়েকটি আদায় করা সম্ভব হয়েছে৷ আন্দোলনের মাধ্যমেই বাকি দাবিগুলি আদায় হবে৷''
‘অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস'-এর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অমরজিৎ কৌর বললেন, ‘‘সবার আগে গৃহকর্মীদের ‘কর্মী' হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে৷ এ জন্য জাতীয় স্তরে একটি নীতি নির্ধআরণ অত্যন্ত জরুরি৷ তারপর বেতন কাঠামো ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন৷''
তবে সম্প্রতি গৃহকর্মীদের সামাজিক ও আইনি সুরক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ভারতের শ্রম মন্ত্রক একটি আইনের খসড়া তৈরি করেছে৷ সংশ্লিষ্ট সব মহলের কাছে পরামর্শ চাওয়া হয়েছে৷ কিন্তু সমাজের বিভিন্ন মহল থেকে আওয়াজ উঠছে, গৃহকর্মীদের প্রতি অন্যায় রুখতে হলে গৃহকর্মীদের নিয়োগ ও কাজ নিয়ে বিশেষ আইনি সুরক্ষার প্রয়োজন৷ শ্রম কল্যাণ দপ্তরের মহা নির্দেশক রাজিত পুনহানির কথায়, ‘‘পরিচারক ও পরিচারিকাদের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় নিয়ে আসা, নিয়োগের শর্তাবলী, অভিযোগ নথিভুক্ত করার জায়গা এবং তার সমাধান করার জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক গঠনতন্ত্র তৈরি করতে চাইছে শ্রম মন্ত্রক৷ এমনটা বাস্তবাযিত হলে গৃহকর্মীরাও অন্যান্য কর্মীর মতোই মর্যাদা পাবেন৷ যে যার রাজ্যের শ্রম দপ্তরে নাম নথিভুক্ত করাতে পারবেন৷'' ভারতের মতো দেশে গৃহকর্মীদের সুরক্ষা ও যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা নিয়ে বিশেষ চিন্তা নেই আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন (আইএলও)-র৷ তারা ভারত সরকারের নীতি নির্ধারণের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে৷
দেশে গৃহকর্মীর সংখ্যা কত? সরকারের কাছে সেই অর্থে কোনও হিসেব নেই৷ অবশ্য ‘ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অফিস'-এর একটি হিসেব অনুযায়ী, গোটা দেশে ৪০ লক্ষ থেকে এক কোটি গৃহকর্মী ভিন রাজ্যে পাড়ি দেন৷ এঁরা বেশিরভাগই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করেন৷ দেশের পূর্বের রাজ্যগুলি যেমন, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগঢ়, পশ্চিমবঙ্গ থেকে অন্যান্য রাজ্যে রুটি-রুজির জন্য পাড়ি দেয় এঁরা৷
সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে কাজ করেন কলকাতার অম্বিকেশ মহাপাত্র৷ তিনি মনে করেন, দেশভাগের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা এসেছিল ১৯৪৭ সালে৷ তারপর ১৯৫০ সালে সংবিধান গৃহিত হয়েছিল৷ এর ৬৭ বছর পরেও দেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনও দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করেন৷ এটা দুর্ভাগ্যজনক৷ তাঁর কথায়, ‘‘দেশের বহু মানুষ অন্যের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করে বেঁচে আছেন৷ এঁরা উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের অমানবিক, অনৈতিক আচরণের শিকার৷ শ্রমিক হিসেবে তো দূর, মানুষ হিসেবে স্বীকৃতিটুকুও মেলে না অনেক সময়৷ কিন্তু এই লজ্জা থেকে মুক্তি পেতে রাজনৈতিক নীতি নির্ধারণ জরুরি৷ প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে৷ সেইসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকে গৃহকর্মীদের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতি ও আইন তৈরি করতে হবে৷'
একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রকল্প কর্মকর্তার প্রশ্ন, ‘‘সরকারের খসড়া শুধুমাত্র ‘গাইডলাইন'৷ আইন মেনে অপরাধ দমনের উপযুক্ত নয়৷ যৌন নির্যাতন, বেতন আটকে রাখা, বন্দি করে রাখার মতে ঘটনা ঘটলে কী হবে? গৃহকর্মীরা কি আদালতে যেতে পারবেন? দর কষাকষি ছাড়া একটি বেতন নীতি তৈরি হওয়া উচিত৷ এবার এ সব নিয়ে সরকারের ভাবা উচিত৷''
রাজধানী দিল্লির পার্শ্ববর্তী শহর নয়ডায় এক বহুতলে অভিজাত পরিবারে পরিচারিকার কাজ করতেন বাংলাদেশ থেকে আসা ২৬ বছরের মালতী (নাম পরিবর্তিত)৷ গত জুলাই মাসে পুলিশের কাছে একটি অভিযোগ দায়ের করেন তিনি৷ অভিযোগ, তাঁকে শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি চুরির অভিযোগে বন্দি করে রেখেছিল গৃহকর্তা ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা৷ শেষমেশ মালতীর পরিবার ও আত্মীয়স্বজনরা ঐ আবাসনের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ দেখানোর পর তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়৷ পরে তদন্তে জানা যায়, দু-'মাস ধরে বেতন দেওয়া হয়নি মালতীকে! এই একটি ঘটনা থেকে গোটা ভারতে গৃহকর্মীদের দুর্দশার আঁচ পাওয়া যেতে পারে৷
চলতি বছরের গোড়ায় মুম্বইয়ের অভিজাত আবাসন কমপ্লেক্সের আবাসিকদের দুর্ব্যবহার ও উপযুক্ত মজুরি না দেওয়ার প্রতিবাদে ধর্মঘট করেছিলেন গৃহকর্মীরা৷ তখনকার মতো গৃহকর্মীদের দাবি মেনে নেন আবাসিকরা৷ কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আন্দোলনকারী সমস্ত গৃহকর্মীকে কাজ থেকে বের করে দেওয়া হয়৷
সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের বক্তব্যের যেটুকু নির্যাস পাওয়া গেল তা হলো, সরকারি নীতি নির্ধারণ করে অন্যান্য কর্মীদের মতোই গৃহকর্মীদের স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি পরিচারক ও পরিচারিকাদের প্রতি সাধারণ মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি৷ তেমনটা সম্ভব হলে তবেই গৃহকর্মীদের স্বার্থ রক্ষা হবে এবং তাঁরা সুরক্ষিত বোধ করবেন৷
প্রতিবেদনটি কেমন লাগলো? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷