ভারতে পরিবেশবান্ধব বাড়িঘরের প্রবণতা বাড়ছে
২৫ নভেম্বর ২০২০নতুন দিল্লিতে মাথা তুলে তাকালেই আধুনিক বহুতল অট্টালিকা ও অত্যন্ত খারাপভাবে পরিকল্পিত নির্মাণের উদাহরণ চোখে পড়বে৷ জলবায়ু সংক্রান্ত বিতর্কের ক্ষেত্রে ভবনের কার্বন নির্গমনের বিষয়টিকে সাধারণত অবহেলা করা হয়৷ কিন্তু শুধু ভারতেই ভবন ও সেগুলির নির্মাণের কারণে প্রায় ৪০ শতাংশ কার্বন নির্গমন ঘটে বলে অনুমান করা হয়৷
স্থপতি হিসেবে নীলাঞ্জন ভোয়াল গত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে টেকসই ও কার্যকর ভবনের ডিজাইন করে চলেছেন৷ তাঁর মতে, বর্তমানে এমন ভবনের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেড়ে গেছে৷ কিন্তু ‘গ্রিন বিল্ডিং’ ডিজাইনের সংজ্ঞা সম্পর্কে এখনো অনেক বিভ্রান্তি রয়ে গেছে৷ নীলাঞ্জন বলেন, ‘‘মানুষের সবচেয়ে বড় ভুল ধারণা হলো, গ্রিন হোম আসলে অনেক সবুজ গাছভরা একটা বাসা৷ প্রচুর গাছপালা, ঘাস লাগালেই ভবনটি সবুজ হয়ে যাবে৷ আসলে কিন্তু সেটা একেবারেই ঠিক নয়৷ গ্রিন বিল্ডিং তখনই পরিবেশবান্ধব হয়ে ওঠে, যখন প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা করে পুনর্ব্যবহারযোগ্য সম্পদ ব্যবহার করা হয়, জঞ্জাল ও সম্পদের ব্যবহার কমানো হয় এবং অনেক উপাদান পুনর্ব্যবহার করা হয়৷’’
সাফল্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
নতুন দিল্লি শহরে ভোয়ালের একটি ডিজাইন ভারতের প্রথম পাঁচতারা ‘সবুজ’ আবাসনের স্বীকৃতি পেয়েছে৷ ‘গ্রিন ওয়ান’ নামের ভবনটি যতটা সম্ভব পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তোলা হয়েছে৷ বড় বড় জানালার দৌলতে ঘরে অনেক আলোবাতাস ঢোকে৷ ভারতে অপেক্ষাকৃত নতুন ‘ডবল গ্লেজিং’ প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ভবনটিকে ইনসুলেট করা হয়েছে৷ ফলে গ্রীষ্মকালের তীব্র উত্তাপ সত্ত্বেও ভেতরটা ঠাণ্ডা থাকে৷
ভবনটি পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানিও উৎপাদন করে এবং বৃষ্টির পানি জমা করে৷ ফলে প্রায় ৭৫ শতাংশ পানির চাহিদা মেটানো যায় এবং বিদ্যুতের ব্যবহারও অনেক কমানো যায়৷ এভাবে নির্মাণের ব্যয় বেশি হলেও দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে আখেরে লাভ হয়৷ নীলাঞ্জন ভোয়াল বলেন, ‘‘আমার মতে, ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি ব্যয় হলেও লাভ হয় বৈকি৷ পাঁচ বছরের মধ্যে টাকা উঠে আসে এবং তারপর কার্যত বিনামূল্যেই সবকিছু চলে৷ অর্থাৎ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবং পরিবেশকে আপনি সম্পদ ফিরিয়ে দিচ্ছেন৷ এবার আমরা ‘জিরো কার্বন' লক্ষ্যমাত্রা পূরণের পথে এগোচ্ছি৷ এমন ভবন, যেখানে কার্বন নির্গমনের তুলনায় আরও বেশি ফিরিয়ে দেওয়া হবে৷ বর্তমানে এমন সমাধানসূত্রের প্রয়োজন৷’’
বর্তমানে ভারতে প্রায় ১৪ লাখ আধুনিক ‘সবুজ’ ভবন রয়েছে. যা আবাসন ক্ষেত্রের মাত্র পাঁচ শতাংশ৷ ভারতীয় সবুজ ভবন পরিষদ আগামী দুই বছরের মধ্যে সংখ্যাটি দশ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর আশা করছে৷ কিছু রাজ্য সরকার পরিবেশবান্ধব নির্মাণ পদ্ধতির ক্ষেত্রে ছাড় দিতেও শুরু করেছে৷
চিরায়ত নির্মাণশৈলি থেকে শিক্ষা
তবে ভারতের গ্রামাঞ্চলে হাতে করে যে অসংখ্য বাড়িঘর তৈরি করা হয়, সেগুলি এই তালিকায় স্থান পায় না৷ এমন ঘরবাড়ি অবশ্য প্রায়ই যথেষ্ট পরিবেশবান্ধব হয়৷ নীলাঞ্জন বলেন, ‘‘আমরা সবসময়ে আমাদের পুরানো কাঠামো থেকে প্রেরণা পাই৷ অতীতে আমরা যেভাবে বাড়িঘর তৈরি করতাম, সেই প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে সেরা কাঠামো গড়ে উঠতো৷ আমরা সেই পদ্ধতিকে আধুনিক যুগের উপযোগী করে তুলছি, যাতে আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে সেই সব উপাদান কাজে লাগানো যায়৷ আজকের দিনে সেগুলি প্রাসঙ্গিক ও রক্ষণাবেক্ষণের উপযোগী হয়ে উঠবে৷’’
নীলাঞ্জন ভোয়াল ২০০০ সালে নিজের বাসভবনেরও সংস্কার করেন৷ ঐতিহ্যবাহী ও পরিবেশবান্ধব প্রক্রিয়া থেকে তিনি প্রেরণা পেয়েছিলেন৷ এর দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘‘টয়লেটে ব্যবহৃত সব ভাঙা টাইল আমি ব্যবহার করেছি৷ অর্থাৎ যা কিছু ভাঙা হয়েছে, সেগুলি নক্সা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে৷ বেশিরভাগ টাইল রঙিন হওয়ায় সেগুলি উত্তাপ প্রতিফলন করে৷’’
সচেতনতাই চাবিকাঠি
বর্তমানে আরও মানুষের হাতে প্রাথমিক বিনিয়োগের জন্য অর্থ রয়েছে৷ পরিবেশের উপর নিজস্ব সিদ্ধান্তের প্রভাব সম্পর্কেও ভারতে সচেতনতা বাড়ছে৷ নীলাঞ্জন ভোয়াল মনে করেন, ‘‘টেকসই পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতনতা নিজের ঘর থেকেই শুরু করতে হবে বলে আমি বিশ্বাস করি৷ আগে পরিবেশবান্ধব জীবনধারা, তারপর গ্রিন বিল্ডিং৷ আমার মতে, সেই সচেতনতা আসছে৷ মহামারি থাকুক বা না থাকুক, এই মনোভাব বাড়বে৷ আমি নিশ্চিত, যে কোভিড-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ঘরবাড়ি আরও সহজসরল করে তোলার চাহিদা আরও বাড়বে৷ এখনই গ্রাহকদের কাছ থেকে আরও পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপের অনুরোধ আসছে৷ গাছপালা লাগিয়ে পরিবেশ দূষণ সামলানোর তাগিদও বাড়ছে৷’’
ভবিষ্যতে ভারত কি গ্রিন বিল্ডিংয়ে ভরে যাবে? নীলাঞ্জন ভোয়ালের মতো স্থপতির মনে এমন আশাই কাজ করছে৷ তাঁরা এ ক্ষেত্রে নিজস্ব অবদান রাখতে প্রস্তুত৷
লুইসে অসবোর্ন/এসবি