ভারতের রোহিঙ্গারা কি ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকেন?
৯ সেপ্টেম্বর ২০২২দিল্লি থেকে নুয়ের রাস্তা খুব বেশি হলে ঘণ্টা দুয়েক৷ আরাবল্লির পায়ে হরিয়ানা-রাজস্থান সীমানায় ছোট্ট জনপদ৷ এক পরিচিত নুয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন৷ তাকে ফোন করে বলেছিলাম, ক্যাম্প ঘুরে দেখতে চাই৷ খানিক চুপ থেকে, চারবার পরিচয় যাচাই করার পর ওই ব্যক্তি জানতে চাইলেন, কবে কখন কতজন যাবে তাদের ক্যাম্পে? প্রশ্নের ধাঁচ এমন, যেন সেই মতো টিকিট কেটে রাখা হবে৷
ফোনে বেশি কথা হয় না৷ নির্দিষ্ট দিনে প্রবল বৃষ্টিতে গাড়ি নিয়ে পৌঁছানো গেল নুয়ে বাজার ছেড়ে জনবসতি ছেড়ে একদিকে ডোবা আর অন্যদিকে ময়লার স্তূপ পেরিয়ে যেখানে ফের জীবনের চিহ্ন মিলল, খুব দায়ে না পড়লে মানুষ সেখানে বাঁচতে পারে না৷
সাংবাদিকতার সূত্রে বহু ঘাট ঘুরতে হয়েছে, কিন্তু এমন পুতিগন্ধময় অঞ্চল দেখার সুযোগ এই প্রথম৷ বৃষ্টিতে কাঁদায়, নোংরায় মাখামাখি পরিস্থিতিতে কোনোমতে ছাউনি বানিয়ে পর পর ঘর৷ তার পাশে দোকান৷ তার পাশে টিনের মসজিদ, মসজিদের উঠোনে মাদ্রাসা৷ এই সব কিছুই দেখার সুযোগ হবে আরো অন্তত তিনঘণ্টা বাদে৷ কেন?
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সামনে পৌঁছাতেই ঘিরে ধরল একদল ছেলে৷ পাশাপাশি দুইটি ক্যাম্পের বাসিন্দা৷ জানিয়ে দিল, ক্যাম্পে ঢোকার অনুমতি নেই৷ সাংবাদিক জানালো, ফোনে কথা বলেই সে এসেছে৷ জনৈককে ডেকে আনলেই বিষয়টি বোঝা যাবে৷ ছেলেরা জানালো, ওই ব্যক্তি থানায় গেছেন৷ যতক্ষণ না ফিরবেন, ক্যাম্পে ঢুকতে দেওয়া যাবে না৷
জনৈককে ফোন করা হচ্ছে৷ ধরছেন না৷ এমনই পরিস্থিতিতে এখনো মনে পড়ে, ওই ছেলের দলের ভিড় থেকেই উঁকি মেরেছিল একটি বাচ্চা৷ নাকে রুমাল দেওয়া দেখে হেসে মন্তব্য করেছিল, ‘‘কাজের জন্য একটা রাত থাকতে পারবে আমাদের ঘরে? ক্যাম্পে ঢোকার আগেই তো নাকে রুমাল উঠে গেছে!’’ লজ্জা করেছিল খুব৷ কিন্তু রুমাল সরাতে পারিনি৷
প্রায় ঘণ্টা তিনেক কেটে যাওয়ার পরে ধৈর্য্যের সীমা যখন বিপদসীমায় পৌঁছে গেছে, হাজির হলেন জনৈক৷ তিনঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন না৷ জানালেন, এক ঘণ্টার জন্য ক্যাম্পে ঢোকা যেতে পারে, পুলিশ তেমনই জানিয়েছে৷
পুলিশ? সাংবাদিক ক্যাম্পে ঢুকবে, তার জন্য রোহিঙ্গা শরণার্থীকে পুলিশের অনুমতি নিতে হবে কেন? হাসলেন জনৈক৷ জামা তুলে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়ালেন৷ গাদা গাদা রুলের দাগ৷ বিভিন্ন সময়ে পুলিশি উপহারের প্রমাণ৷ জনৈক জানালেন, ক্যাম্পের বাইরে পা দিতে হলে তাদের পুলিশকে জানাতে হয়৷ ক্যাম্পে কেউ এলেও অতিথির পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য জানাতে হয় থানাকে৷ থানা অনুমতি দিলে তবেই অতিথি ঢুকতে পারেন৷ সাংবাদিক, চিকিৎসক কারও ছাড় নেই৷
কথার ব্যত্যয় হলে উপহার বাঁধা৷ বস্তুত, বিনা কারণে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করে, এমন অভিযোগও আছে৷ জনৈকের মুখে এই সব গল্প শুনতে শুনতেই ঘুরে দেখছিলাম ক্যাম্প৷ একুশ শতকেও মানুষ যে এভাবে বাঁচতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না৷
কীভাবে জীবন চলে এভাবে? ‘‘চলে না৷’’ একবাক্যে জানিয়ে দিলেন এক বৃদ্ধ৷ ছেলেরা বাঁশের কাজ করে ক্যাম্পেই, তা থেকে সামান্য রোজগার৷ কেউ কেউ পরিচয় গোপন রেখে দিন মজুরের কাজে যায়৷ তবে পুলিশ জানতে পারলে অশেষ নির্যাতন৷ হাসপাতালে জায়গা নেই, শিশুদের পড়াশোনার সুযোগ নেই৷ এক বিচিত্র জীবন৷ বৃদ্ধ বলছিলেন, এ আসলে এক খোলা জেল৷ লোহার গারদগুলো খালি চোখে দেখা যায় না৷ কিন্তু যারা বাস করেন ক্যাম্পে, তারা প্রতিদিন ওই গারদের প্রবল বাস্তবতা বুঝতে পারেন৷
তবু ভারত ছেড়ে যেতে রাজি নন এই উদ্বাস্তুরা৷ তারা জানেন, ভারত সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জায়গা দিতে চায় না৷ তারা জানেন, এদেশে কার্যত তাদের কোনো ভবিষ্যত নেই৷তারা জানেন, এদেশের মানুষের একটা বড় অংশ বিশ্বাস করে রোহিঙ্গার সমার্থক শব্দ অপরাধ৷ তবু তারা থাকতে চান৷ ফিরে যেতে চান না মিয়ানমারে৷ এই ভয়াবহ পরিবেশও তাদের কাছে রাখাইনের অত্যাচারের থেকে আরামের৷ ক্যাম্পের অনেকেই বাংলাদেশের ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এসেছেন৷ অল্প অল্প বাংলা বলতে পারেন৷ কিন্তু বলেন না, সম্পূর্ণ ভুল হলেও তারা হিন্দিতে কথা চালিয়ে যান৷ তাদের বিশ্বাস, একদিন এই ক্যাম্পের বাইরে তারা পা রাখতে পারবেন৷ একদিন নাগরিক অধিকার ভোগ করবেন তারাও৷
এখনই করেন না কি? ক্যাম্প থেকে পালিয়ে পরিচয় বদলে ভুয়া পরিচয়পত্র তৈরি করেননি কি কেউ? করেছেন৷ আলাপ হয়েছে তেমন মানুষের সঙ্গেও৷ অতীতের দিকে ফিরেও তাকাতে চান না তারা৷
দিল্লি, নু, জম্মুতে এমন একাধিক রোহিঙ্গা ক্যাম্পের গল্পগুলো আসলে এমনই৷ পরিবেশ, ভাবনা, লড়াই-- বদলায় না কিছুই৷
সম্প্রতি ভারত সফরে এসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে ভারতের সাহায্য চেয়ে গেছেন৷ ভারত যাতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের সঙ্গে কথা বলে, সে আর্জি জানিয়ে গেছেন৷ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের সঙ্গে সংলাপে ভারতের আপত্তি আছে৷ আবার ভারতে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের ন্যূনতম সুযোগ সুবিধা দেওয়ার বিষয়েও মোদী সরকার আগ্রহী নয়৷
রাজদরবারে বাতি জ্বলে বাতি নেভে, ক্যাম্পের জীবনে আলো পৌঁছায় না৷
গত বছরের সেপ্টেম্বরের ছবিঘরটি দেখুন...