ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১২সেই ১৯৫২ থেকে ২০১২৷ এর মাঝে পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ ষাট বছর৷ ভাষা আন্দোলনের ষাটতম দিবস উদযাপনের এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সে আন্দোলনের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিগুলোকে কীভাবে মূল্যায়ন করছে তরুণ প্রজন্ম?
তরুণদের মতামত জানতেই কথা বলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণীর ছাত্রী দিলশাদ হোসেন দোদুলের সাথে৷
দোদুল বলছেন, ‘‘ষাট বছরে আমাদের প্রাপ্তি অনেক৷ আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে সারা পৃথিবীতে৷ এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের একটি অর্জন''৷
কিন্তু দোদুলের মতো এতোটা ইতিবাচক হতে পারছেন না একই বিভাগেরই ছাত্র নূরে আলম দুর্জয়৷
তিনি বলছেন, ‘‘ভাষা আন্দোলনের মূল দাবি ছিলো সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন ঘটানো৷ কিন্তু আজো সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন হয় নি৷ এখনো উচ্চ শিক্ষা ও উচ্চ আদালতের ভাষা ইংরেজি৷ এখনো সরকারি বেসরকারি অনেক অফিসে রয়েছে ইংরেজির প্রাধান্য৷''
শুধু তাই নয়, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির জায়গাটিকে আরো নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করছেন দুর্জয়৷
তিনি বলছেন, ‘‘বাংলাদেশের আদিবাসীরা আজো তাদের মাতৃভাষায় পড়ালেখার অধিকার থেকে বঞ্চিত৷ কিন্তু এমনটি হবার কথা ছিলো না৷ কথা ছিলো সব ভাষা সমান মর্যাদা পাবে৷ অথচ বর্তমানে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের আদিবাসী ক্ষুদ্র ভাষার ওপরে সেই উর্দুর মতোই আজ আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে বাংলা ভাষা৷'' তার মতে, ‘‘এটি ভাষা আন্দোলনের চেতনা বিরুদ্ধ''৷
ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পূর্তির দিনে এসে তরুণেরা যখন পিছু ফিরে তাকিয়েছেন, খতিয়ে দেখছেন প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির চারপাশ, তখন প্রবীণ ও প্রাজ্ঞজনের চোখে কীভাবে ধরা দিয়েছে এই আন্দোলনের ছয় দশক পূর্তির মূল্যায়ন?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলছেন, ‘‘ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাকে পরিত্যাগ করে আমরা গ্রহণ করি ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদ৷ আর তারই পথ ধরে আসে আমাদের স্বাধীনতা৷ সুতরাং বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে ভাষা আন্দোলনের অবদান অশেষ৷ ''
প্রাপ্তির কথাগুলো যেমন বলেছেন তিনি, তেমনি জানিয়েছেন ভাষা আন্দোলনের স্বপ্নভঙ্গের কথকতাও৷
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের উচ্চ আদালত ও উচ্চশিক্ষার মাধ্যম এখনো ইংরেজি৷ এখনো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলোর অধিকাংশ বই ইংরেজিতে৷ শুধু যে উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি তাই নয়, আমাদের দেশে প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রেও আছে বিভাজন৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘এই দেশে একই সঙ্গে তিন ধরণের শিক্ষা পদ্ধতি চলছে৷ বাংলা, ইংরেজি এবং মাদ্রাসা শিক্ষা৷ মাদ্রাসা শিক্ষা এবং ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে বাংলার কোনো গুরুত্বই নেই৷ এটা খুবই দুঃখজনক৷''
সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের যে দাবি আজো পূরণ হয় নি তা কীভাবে পূরণ হতে পারে? তারই কিছু পথও দেখাচ্ছেন তিনি৷
তিনি বলেন, ‘‘সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে৷ মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রচলন করতে হবে৷ একই দেশে তিন ধরণের শিক্ষা পদ্ধতি নয়, ধনী-দরিদ্র সবার জন্য একধরণের শিক্ষা চালু করতে হবে৷ পাশাপাশি বাংলা ভাষায় প্রচুর সাহিত্য লেখা ও গবেষণা করতে হবে যাতে ভাষা আরো সমৃদ্ধ হয়৷'
আর নূরে আলম দুর্জয় যোগ করেছেন যে, ‘‘শুধু সরকারি চেষ্টা বা শুধু আইন দিয়ে ভাষার দাবি পূরণ হবে না৷ পরিবর্তনটা আনতে হবে চেতনায়; আন্দোলনটা শুরু করতে হবে ঘর থেকে৷''
তরুণ শিক্ষার্থী ও প্রবীণ শিক্ষক সবাই কিছু সিদ্ধান্তে একমত হয়েছেন৷ তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের আছে এক অশেষ অবদান৷ কিন্তু এখন সময় এসেছে, আমাদের অপ্রাপ্তির জায়গাগুলোকে খতিয়ে দেখার৷ এখন প্রয়োজন, ভাষাটিকে আরো বেশি ভালোবেসে ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে সমুন্নত করার৷
প্রতিবেদন: আফরোজা সোমা
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল ফারুক